সুষ্ঠু বিচার, ক্ষতিপূরণ এবং সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোচিং ব্যবসা বন্ধসহ ৮ দফা দাবিতে কাফন মিছিল ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের পরিবারের সদস্যরা। তারা অভিযোগ করেন, এ বিষয়ে কোনো কর্মসূচি যাতে পালন করা না হয় সেজন্য সতর্ক করে মাইলস্টোন কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষকরা মোবাইল ফোনে বিভিন্ন হুমকি দিচ্ছেন।
গতকাল মঙ্গলবার উত্তরার দিয়াবাড়ী গোলচত্বরে মানববন্ধন থেকে এমন অভিযোগ করে নিহত ও আহতদের পরিবারের সদস্যরা।
মানববন্ধনে অংশ নিয়ে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহত শিক্ষার্থী মারিয়াম উম্মে আফিয়ার মা উম্মে তামিমা আক্তার বলেন, ‘আমার বাচ্চাটাকে আমি কখনো কোচিংয়ে দিতাম না। আমার বাচ্চাটাকে দেড় মাস হয়েছে কোচিংয়ে দিসি। কেন দিয়েছি জানেন? আমার বাচ্চা বাসায় এসে আমাকে বলে, আম্মু আমি যদি কোচিং না করি, মিসরা আমাকে আদর করে না’। আফিয়া স্কুলের বাংলা মাধ্যমের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল।
কোচিংয়ে দেওয়ার পর মেয়ে খুশি ছিল জানিয়ে তামিমা আক্তার বলেন, ‘যখন বাচ্চাটাকে কোচিংয়ে দিলাম, এক সপ্তাহ পর আমার ময়না পাখি, আমারে জড়াইয়া ধইরা বলে, মা মিসরা আমাকে এখন অনেক আদর করে।’ তামিমা আক্তার আরও বলেন, ‘এখানে যে বাচ্চাগুলো মারা গেছে, সব কোচিংয়ের বাচ্চা।... কোচিংয়ের বড় একটা অংশ তাদের কাছে যায়, বড় একটা অ্যামাউন্ট তারা পায়... এ স্কুলে কোচিংয়ের জন্য যতটা প্রেশার দেওয়া হয়, আমার মনে হয় না, অন্য কোথাও এত প্রেশার দেওয়া হয়।’ তিনি আরও বলেন, পরীক্ষায় খারাপ করিয়ে কোচিংয়ের জন্য চাপ দেওয়া হয়। অভিভাবকেরা কোচিংয়ের পক্ষে নন বলেও জানান তিনি।
মানববন্ধনে মাইলস্টোন স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির নিহত শিক্ষার্থী ফাতেমা আক্তার ওরফে আনিসার মামা লিয়ন মীর অভিযোগ করেন, ‘অভিভাবকদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা হচ্ছে। হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে। ভয়ভীতি দেখিয়ে আমাদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছে মাইলস্টোন কর্তৃপক্ষ।’
তিনি আরও বলেন, শিক্ষকদের আচরণে আমরা ক্ষুব্ধ। আমরা চাই এই ঘটনার জন্য দায়ীদের শাস্তি হোক।
নিহত রাইসা মনির মা মীম আক্তার বলেন, ‘আমার মেয়েটা তো আর ফিরে আসবে না। কিন্তু অন্তত যেন আর কোনো মা তার সন্তানকে এভাবে না হারায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। এই দুর্ঘটনার জন্য যারা দায়ী, তাদের বিচার না হলে আমরা কোথায় যাব? বাচ্চাকে স্কুলে পাঠিয়েছিলাম পড়াশোনার জন্য, লাশ ঘরে আসবে তা তো ভাবিনি। এই ব্যথা সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।’
মানববন্ধনে উপস্থিত অভিভাবক আব্দুল মান্নান ক্ষোভ নিয়ে বলেন, ‘এটা শুধু দুর্ঘটনা নয়, অবহেলার ফল। স্কুলের লোকজন আমাদের সঙ্গে এমন আচরণ করছে, যেন আমরা দোষী। আমাদের চোখে ধুলো দেওয়ার চেষ্টা তারা বন্ধ করুক। আমার ঘর এখন নীরব ও নিস্তব্ধ। বইয়ের ব্যাগ, স্কুল ড্রেস সব ঘরেই পড়ে আছে। কিন্তু আমার সন্তান নেই। যে ভুলে আমার বাচ্চা চলে গেছে, সেই ভুল যেন আর না হয়।’
নিহত ও আহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ঘোষিত ৮ দফা দাবি বাস্তবায়ন করতে হবে। এ সময়সীমার মধ্যে দাবিগুলো পূরণ না হলে আরও কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারিও দেন তারা।
এ সময় পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে ৮ দফা দাবি তুলে ধরেন নিহত ফাতেমার মামা লিয়ন মীর। এর মধ্যে রয়েছেÑ দুর্ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করা, সারা দেশে মাইলস্টোনসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করা, সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিটি নিহত শিক্ষার্থীর জন্য ৫ কোটি টাকা এবং প্রতিটি আহত শিক্ষার্থীর জন্য ১ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া। পাশাপাশি স্কুলের পক্ষ থেকেও প্রতিটি নিহতের পরিবারকে ২ কোটি টাকা এবং আহতদের ১ কোটি টাকা করে দেওয়ার দাবি জানানো হয়।
এ ছাড়া রানওয়ে থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্থান পরিবর্তন অথবা রানওয়ের অবস্থান পরিবর্তন, কোচিং ব্যবসার মূল হোতা হিসেবে অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষিকা খাদিজাকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে অপসারণ ও সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে বিচার, স্কুলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পরিবারের কাছে প্রদর্শন এবং বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা জনহীন এলাকায় সরিয়ে নেওয়ার দাবিও উত্থাপন করে পরিবারগুলো।
এদিকে অভিভাবকরা অভিযোগ করেন, শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন পালনের সময় মাইলস্টোন কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকরা নিহত এবং আহত শিক্ষার্থীদের পরিবারের সদস্যদের আঘাত করেন। নিহত শিক্ষার্থী সায়মার বাবাও মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন। মাইলস্টোনের শিক্ষক কনক তাকে আঘাত করেছেন বলে জানানো হয়।
গতকাল মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে গিয়ে দেখা যায়, স্কুল প্রাঙ্গণ থেকে মেট্রোরেল ডিপোর সামনে সড়ক পর্যন্ত ব্যারিকেড দিয়ে রাখা হয়েছে। এ সময় আশপাশে পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন