ভয়ংকর লুটের শিকার হয়ে সাদাপাথরের চিরচেনা দৃশ্য পুরোটা পাল্টে গেছে। গত এক বছর ধরে চলা নির্বিচারে পাথর উত্তোলনে এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এখন পুরোপুরি ধ্বংস। স্থানীয় পাথরখেকো সিন্ডিকেট, স্থানীয় ও জেলা প্রশাসনের কমিশনখেকো কর্তা এবং রাজনৈতিক নেতাদের যৌথ থাবায় সাদাপাথর এখন পাথরশূন্য। পরিণত হয়েছে বিরানভূমিতে। অনেকটা মরুভূমির আকার ধারণ করেছে কিছুদিন আগেও পাথরে ঢেকে থাকা সিলেটের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র সাদাপাথর।
সাম্প্রতিক সময়ে চুরি ব্যাপক আকারে বেড়ে গিয়ে সাদাপাথর থেকে পাথর হাওয়া হয়ে যাওয়া প্রকাশ্যে আসার পর থেকে দেশব্যাপী বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। এরই এক পর্যায়ে গত সোমবার বিএনপি বহিষ্কার করে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি শাহাবুদ্দিনকে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ একাধিক। এর মধ্যে একটি সাদাপাথর থেকে পাথর লুট। ঘটনা সত্য। তবে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ভেতরের আরও না জানা তথ্য। শাহাবুদ্দীন পাথর লুটের সঙ্গে জড়িত থাকলেও মূল কলকাঠি নাড়ছেন যারা, তাদের রক্ষা করতেই মূলত শাহাবুদ্দীনকে বলির পাঁঠা বানানো হয়েছে। তার ইস্যুটি সামনে আনা হয়েছে।
স্থানীয় একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, কোম্পানীগঞ্জ আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আলফু মিয়া, উপজেলা বিএনপির সভাপতি শাহাবুদ্দিন, সিলেট জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মকসুদ আহমদ, সহসাধারণ সম্পাদক বাহার আহমদ রুহেল, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সিয়াস উদ্দিন এবং রজন মিয়ার নেতৃত্বে মূলত পাথর লুটের ঘটনা ঘটছে। কেন্দ্র ও সিলেট জেলা বিএনপির কয়েকজন শীর্ষ নেতার সেল্টারে এরা পাথর লুটের মহোৎসব করছেন, যার ভাগ পেয়েছেন তারাও। তাদের সঙ্গে আড়ালে জামায়াতে ইসলামীর কয়েকজন রয়েছেন। এই চক্র স্থানীয় আরও কয়েকজন পাথরখেকোর মাধ্যমে অন্তত ২০০ কোটি টাকার পাথর সাদাপাথর থেকে সাবাড় করে নিয়েছেন। পরিবেশকর্মী ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, একসময় যেখানে সাদাপাথরের বিছানা ছিল, সেখানে এখন শুধু ধু-ধু বালুচর। কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায় এমন ঘটনার ফলে পর্যটনকেন্দ্রটির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত সবাই।
ওই সূত্রের দাবি, প্রকাশ্যে স্থানীয় ও জেলা প্রশাসন পাথর লুটের বিরুদ্ধে দেখালেও আড়ালে তারাই বড় অঙ্কের কমিশন পেয়ে পাথর সাবাড় হওয়ার সমস্ত বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। গত সোমবার মকসুদ ও তার বাহিনীর পাথর লুটের প্রতিবাদে ধলাই সেতু রক্ষা আন্দোলন নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে সমাবেশ করা হয়। সেখানেও তারা চক্রের নাম উল্লেখ করেছে।
সংগঠনের সদস্যসচিব নিজাম উদ্দিন মাস্টার দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এক বছর আগের যে সাদাপাথর, সেটি এখন আর নেই। পুরোটাই বিলীন। এখন তারা ধলাই সেতু এলাকার দিকে নজর দিয়েছে। সেখানে লিজ আনার নামে বালু লুট করে সিলেটের দ্বিতীয় দীর্ঘ সেতু ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। খেলার মাঠ, কবরস্থান, বাড়িঘর এখন হুমকির মুখে। ধলাই সেতু রক্ষায় গত ১৩ জুলাই থেকে এলাকাবাসী বালু উত্তোলন বন্ধের জন্য ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করেছে।
সূত্র জানায়, একসময় রাতের আঁধারে মাঝেমধ্যে পাথর চুরি হলেও গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে বেপরোয়া হয়ে ওঠে পাথরখেকো চক্র। তারা দিন-দুপুরে চুরি করে নেয় সাদাপাথর। পরে স্থানীয় সচেতন মহল ও সেনাবাহিনীর কারণে তা অনেকটা বন্ধ হয়। কিন্তু তবু সুযোগ বুঝে চলেছে লুটপাট। বিভিন্ন সময়ে প্রশাসন ধলাই নদীতে অভিযান চালালেও বন্ধ হয়নি লুটপাট। এক সপ্তাহ লুটপাট হলে অভিযান হতো এক দিন। আর ওই দিন বাদে বাকি ছয়দিনই চলত লুটপাট। যেদিকে পাথর কেনাবেচা হয় এবং গাড়ি বা বড় নৌকা করে পাথর যায়, সেদিকে অভিযান হতো না বলে লুটপাট বন্ধ হয়নিÑ দাবি এলাকাবাসীর। এ কারণে এখন সেখান থেকে পাথর বিলীন হয়ে গেছে।
প্রশাসনের সামনে দিয়ে বালু-পাথর লুট করে নিয়ে গেলেও তারা কোনো কর্ণপাত করেননি। সাদাপাথর লুটের জন্য ওই এলাকার বাসিন্দারা এখন রাজনৈতিক দলের চেয়ে প্রশাসনকেই দুষছেন বেশি। তারা বলছেন, প্রশাসনের ব্যর্থতা আর মদতে এই লুটপাট চলছে। তারা নিজের দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। সাদাপাথর তোলায় অংশ নিয়েছিলে এমন একজন পাথরশ্রমিক জানান, সেখানে প্রতিদিন প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক পাথর লুটে নিয়োজিত। এখনো তারা পাথর লুট করছেন। এদের মধ্যে পাঁচ ভাগের এক ভাগ স্থানীয়, বাকিরা বহিরাগত। এর মধ্যে বেশির ভাগই সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জের লোক, যারা ধলাই নদীতীরবর্তী এলাকায় ভাড়ায় থেকে প্রতিদিন নৌকা নিয়ে এসে পাথর লুট করেন। শ্রমিকেরা প্রতিদিন তিন থেকে চার ট্রিপ দিতে পারেন।
প্রতি ট্রিপে ২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ২ হাজার ৬০০ টাকা পান। আগে প্রশাসনকে নৌকাপ্রতি ৩০০ টাকা আলাদা করে দিতে হতো। এখন কাউকে দিতে হয় না। যারা পাথর উত্তোলন করান, তারা এটি ম্যানেজ করেন। তিনি জানান, সাদাপাথরে এক নৌকা পাথর তুলতে এক ঘণ্টা লাগে। আর ভরতে ১০ মিনিট লাগে। পরে আমরা সেগুলো নৌকায় করে ধলাই নদীর দুপাশে নিয়েই বিক্রি করতে পারি। সেখানে প্রতি নৌকায় আড়াই-তিন হাজার টাকা পাওয়া যায়।
এদিকে সাদাপাথরের কাছাকাছি রয়েছে তিনটি বিজিবির ক্যাম্প। কালাসাদেক বিওপির অস্থায়ী ক্যাম্প, যেটি সাদাপাথর নৌকা ঘাটের পাশে এবং কালাইরাগ হাজির দানিয়া পয়েন্টে, তাদের চোখের সামনে থাকলেও তারা পাথর লুট থামাতে কার্যকর কোনো ভূমিকাই রাখতে পারেনি। তাদের চোখের সামনে দিয়ে অবাধে সাদাপাথর লুটপাট চললেও তারা ছিলেন অনেকটা নীরব দর্শকের ভূমিকায়। পাথরকোয়ারি বিওপির সামনাসামনিও লুটপাট অব্যাহত আছে। এলাকাবাসী জানান, প্রতিদিন লুটপাট হলেও সেখানে প্রশাসন ১৫-২০ দিনে একবার অভিযান দেয়। তাও তারা শুধু নদীতে অভিযান দেয়।
যারা পাথর কিনে স্টক করে রাখে বা অন্যত্র বিক্রি করে। তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযান হয় না। এ কারণে সাদাপাথর কেনাবেচা চলতেই থাকে। এ প্রসঙ্গে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজিজুন্নাহার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা ডিসি অফিসে কথা বলছি। খুব দ্রুত, হয়তো এই সপ্তাহের মধ্যেই আশা করছি আবার ক্রাশারগুলোতে অভিযান হবে। আগেরবার আমরা অনেকটা শক্ত অভিযানে ছিলাম। পরবর্তী সময়ে পরিবহনশ্রমিকেরা সড়ক অবরোধ করে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এরপর থেকেই এই লুটপাট হচ্ছে।’
এদিকে সাদাপাথর লুটের পর এবার পাথর ও বালুখেকোরা থাবা বসিয়েছে ধলাই সেতুর ওপর। কোম্পানীগঞ্জ আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আলফু মিয়ার অর্থায়নে জেলা প্রশাসন থেকে এখানকার বলুমহাল লিজ এনেছেন মায়া নামের একজন। মূলত মায়ার নামে এলেও প্রকৃতপক্ষে আলফু মিয়াই এখানে মূল ব্যক্তি। স্থানীয়দের ধলাই সেতু থেকে ১৬০০ ফুট দূর থেকে বালু তোলার অনুমতি আছে। কিন্তু তারা একেবারে সেতুর পিলার পর্যন্ত এসে বালু তুলছেন। বালুখেকো চক্রের কারণে কোম্পানীগঞ্জের সম্পদ ও এম সাইফুর রহমান স্মৃতিবিজড়িত ধলাই সেতুও এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
আলফু মিয়ার নিকটাত্মীয় জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মকসুদ আহমদ ড্রেজার দিয়ে সেতুর নিচ ও আশপাশ থেকে দিনে-রাতে বেআইনি বালু উত্তোলন করছেন। তাদের বালু লুটের ফলে স্থানীয় কবরস্থানও ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছে। তাই এখন সেতু রক্ষার সংগ্রামে নেমেছেন স্থানীয়রা। এদিকে এই আন্দোলন বাধাগ্রস্ত করতে তৎপর পাথর ও বালুখেকোরা। আন্দোলন তীব্র হলে গত ১০ আগস্ট রবিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে মকসুদ আহমদের অনুসারীরা সিলেট নগরীতে ‘ধলাই রক্ষা আন্দোলন কমিটির’ সদস্যসচিব নিজাম উদ্দিন মাস্টারের বাসায় হামলার চেষ্টা করেন।
তখন নিজাম উদ্দিন মাস্টার বাসায় ছিলেন নাÑ এ তথ্য জানিয়ে নিজাম উদ্দিন মাস্টার বলেন, পাথর ও বালুমহালগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। এখন অবশিষ্ট যা আছে, আমরা তা রক্ষা করতে চাই। সরকারের শীর্ষ মহলের উচিত এদিকে নজর দেওয়া। রাজনৈতিক নেতাকর্মী ছাড়াও প্রশাসনের কমিশনলোভী কর্মকর্তাদের জন্যই লুটপাট ঠেকানো যাচ্ছে না। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনান বলেন, সাদাপাথরকে কেন্দ্র করে ১৫টি মামলা হয়েছে। ৭০ জনের মতো আসামি গ্রেপ্তারও হয়েছে। স্থায়ীভাবে সাদাপাথর লুটপাট ঠেকাতে বড় অভিযানের প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন