শেখ হাসিনা মূলত নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসন-পুলিশের ওপর প্রভাব এবং দমননীতির মাধ্যমে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে ছিলেন। একই সঙ্গে তার পুরো শাসনব্যবস্থা ভারতের স্বার্থরক্ষায় নিয়োজিত ছিল বলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এক মামলায় তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছেন সদ্যপ্রয়াত লেখক, গবেষক, বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেওয়া তার জবানবন্দিতে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, প্রথম থেকেই শেখ হাসিনা ঠিক করেছিলেন নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করবেন। এ জন্য ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেন, যদিও ১৯৯৬ সালে এর দাবিতে তিনি আন্দোলন করেছিলেন। উমরের ভাষায়, ‘তিনি বুঝেছিলেন, নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে পরবর্তী বার তারা আর জিততে পারবে না।’ নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে পুলিশ ও আমলাতন্ত্র পর্যন্ত সবকিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে তিনি ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন করেছেন।
তিনি বলেন, ২০১৪ সালে ভোটকেন্দ্রে কাউকে ঢুকতেই দেয়নি। ২০১৮ সালে ‘রাতের ভোট’ হয়েছেÑ দিনে ভোট হলেও আসলে ভোট হয়ে গেছে আগের রাতেই। ২০২৪ সালেও একই ঘটনা। এভাবে নির্বাচন করেও তিনি জয়লাভ করেছেন, যদিও জনসমর্থনের কোনো ভিত্তি ছিল না। এসব নির্বাচনে দেখা গেছে তার দল ৩০০ সিটের মধ্যে চার-পাঁচটি সিটও পাবে কি না সন্দেহ। এরপরও তিনি জয়ী হয়েছেন শুধু প্রশাসনের ওপর চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণের কারণে। এটা গোপন কিছু নাÑ সবাই জানে। একটি সরকার যদি চায় যে তারা এইভাবে নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করবে, তাহলে সেটা ঠেকানো কঠিন।
বদরুদ্দীন উমরের মতে, শেখ হাসিনা প্রশাসনকে দুইভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছেনÑ ঘুষ, সুবিধা ও সুযোগ দিয়ে; আবার ভয়ভীতি ও হুমকির মাধ্যমে। এভাবে দ্রুতই আমলাতন্ত্র ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিজের পক্ষে নিয়ে আসেন। শুধু নির্বাচনে কারচুপিই নয়, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকেও নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছেন তিনি। বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দলকে ধীরে ধীরে অকার্যকর করে ফেলা হয়। ব্যাপক গ্রেপ্তার, নির্যাতন, গুম-খুন, টর্চার সেলÑ সবকিছু চালানো হয়েছে। কোনো সভা-মিছিল করতে গেলেও পুলিশ দিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ ও ১৯৯০ সালের আন্দোলনের তুলনায় ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান ছিল সবচেয়ে বিস্ফোরক, সবচেয়ে রূপান্তরমূলক। এই অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। শুধু তিনিই নন, মন্ত্রিসভা থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতারাও দেশত্যাগ করেন। উমরের ভাষায়, ‘এই রকম ব্যাপক দলীয় পতন, আতঙ্ক ও আত্মগোপন বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনো ঘটেনি।’ তিনি প্রতীকী উদাহরণ টেনে বলেন, হাসিনার পালানোর পরদিন থেকেই সারা দেশে শেখ মুজিবের মূর্তি ও মুরাল সাধারণ মানুষ নিজেরা ভেঙে ফেলতে শুরু করে। কেউ নির্দেশ দেয়নিÑ এটি ছিল এক ধরনের ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’, যেখানে দীর্ঘদিনের অবদমিত ক্রোধ বিস্ফোরিত হয়েছে।
অভ্যুত্থানে ছাত্রদের ভূমিকা নিয়েও তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘তারাই এ আন্দোলনের প্রধান চালিকা শক্তি ছিল। ইতিহাসে ছাত্ররা বারবার নেতৃত্ব দিয়েছে, কিন্তু এবারের আন্দোলনে তারা যে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা, সাহস ও আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়েছে, তা বিরল।’ বদরুদ্দীন উমরের মতে, শেখ হাসিনার পুরো শাসন ভারতের নকশায় পরিচালিত হয়েছে। তিনি বলেন, ভারতই একমাত্র রাষ্ট্র, যারা তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। পতনের পরও তিনি ভারতে আশ্রয় নেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিল। তার দাবি, আওয়ামী লীগ এখন আর একটি সাধারণ রাজনৈতিক দল নয়। এটি একপ্রকার ভারতীয় স্ট্র্যাটেজিক এজেন্টের মতো কাজ করছে।’
তিনি বলেন, শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আড়ালে কর্তৃত্ববাদী শাসন ও লুটপাট চালিয়েছেন। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ কথাটি আওয়ামী লীগ দলীয় রেটোরিক ছাড়া কিছু নয়। জনগণের প্রকৃত আকাক্সক্ষাÑ খাদ্য, নিরাপত্তা, কাজÑ এর সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাদের ভাবনার কোনো মিল ছিল না।’ উমরের মতে, শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধকে পরিবারের সম্পত্তি মনে করেছেন এবং শেখ মুজিবকে কেন্দ্র করে একটি ‘ঐতিহাসিক মিথ’ দাঁড় করিয়েছেন। পাঠ্যপুস্তক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা পর্যন্ত সবখানে শেখ মুজিবকে একমাত্র নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ফলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।
তার মতে, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান আওয়ামী লীগের জন্য মুসলিম লীগের মতোই চূড়ান্ত পরিণতি তৈরি করেছে। জনগণের বিশ্বাস থেকে তারা সম্পূর্ণভাবে বিতাড়িত হয়েছে। জাতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের পুনরুত্থান অসম্ভব বলেই মনে হয়।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন