দেশে এখনো হাসপাতাল ও কমিউনিটি ফার্মেসি কার্যক্রম চালু হয়নি। ফলে রোগীরা একদিকে ফার্মাসিস্টের সঠিক পরামর্শ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, অন্যদিকে অপ্রয়োজনীয় ওষুধ সেবন করে স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়ছেন। দেশে অ্যান্টিবায়োটিকের নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবহারে রেজিস্ট্যান্স ভয়াবহ আকার নিচ্ছে, যা শিগগির প্রতিরোধ করা না গেলে জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই রোগীদের স্বার্থে ক্লিনিক্যাল ফার্মাসিস্ট নিয়োগের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ ফার্মাসিস্টস ফোরাম।
গতকাল শনিবার বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ ফার্মাসিস্টস ফোরাম র্যালি, আলোচনা সভা ও সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। এ সময় ফার্মাসিস্টরা ৬ দফা দাবি তুলে ধরেন, যার মধ্যে ক্লিনিক্যাল ফার্মাসিস্ট নিয়োগ ও বেতন কাঠামো উন্নয়নের দাবি জোরালোভাবে উঠে আসে।
দিবসটি উপলক্ষে রাজধানীর একটি হোটেলে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি মো. আজিবুর রহমান। স্বাগত বক্তব্য দেন সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মেহেদী হাসান তানভীর। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের ডিন প্রফেসর ডা. মো. সেলিম রেজা, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. মো. আকতার হোসেন, ফার্মেসি কাউন্সিল অব বাংলাদেশের ডেপুটি ডিরেক্টর মো. আসিফ হাসান, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ডা. মো. আমিরুল ইসলাম, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির ফার্মেসি বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ডা. মো. হারুন-অর-রশিদসহ ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা বক্তব্য দেন।
ফার্মাসিস্টস ফোরামের নেতারা বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও আন্তর্জাতিক ফার্মাসি ফেডারেশনের নির্দেশনা অনুযায়ী, একটি হাসপাতালে প্রতি ২৫ শয্যার বিপরীতে একজন ফার্মাসিস্ট থাকা বাধ্যতামূলক। অথচ দেশের সরকারি হাসপাতালে একজন গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টও নেই। জাতীয় ওষুধনীতি ২০১৬ অনুযায়ী হাসপাতাল ফার্মেসি চালুর নির্দেশনা দেওয়া হলেও দীর্ঘদিনেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।
সংগঠনের সভাপতি মো. আজিবুর রহমান বলেন, দেশের স্বাস্থ্য খাতে মান উন্নয়নের জন্য সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ক্লিনিক্যাল ও হাসপাতাল ফার্মাসিস্ট নিয়োগ অত্যন্ত জরুরি। ফার্মাসিস্টদের পেশাগত স্বীকৃতি ও বেতনকাঠামো উন্নয়নেও সরকার ও শিল্প মালিকদের আরও যতœবান হতে হবে।
সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান তানভীর বলেন, হাসপাতালে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ এবং ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোতে ফার্মাসিস্টদের জন্য আধুনিক ও ন্যায্য বেতন কাঠামো নিশ্চিত করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ফোরামের নেতারা সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি ৬ দফা দাবি তুলে ধরেন। দাবিগুলো হলোÑ সারা দেশের সব হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে ক্লিনিক্যাল ফার্মাসিস্টের পদসৃজন, স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, দেশের সব হাসপাতাল ও প্রাথমিক সেবাকেন্দ্রে দ্রুত ক্লিনিক্যাল ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দিতে হবে। তারা চিকিৎসকের সঙ্গে রাউন্ডে অংশ নিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবস্থাপনা, ডোজ পর্যালোচনা, ড্রাগ ইন্টারঅ্যাকশন ও রোগীর প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণে সহায়তা করবেন এবং ওষুধজনিত বিরূপ প্রতিক্রিয়া (এডিআর) হ্রাস, নিরাপদ ও কার্যকর ওষুধ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করবেন, দেশের সব হাসপাতালে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগের মাধ্যমে হাসপাতাল ফার্মেসি চালু করতে হবে, যা ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকবে।
জাতীয় ওষুধনীতি, ২০১৬ অনুযায়ী চিকিৎসক, ফার্মাসিস্ট ও নার্সের সমন্বয়ে প্রতিটি হাসপাতালে ‘ড্রাগ অ্যান্ড থেরাপিউটিকস কমিটি (ডিটিসি)’ গঠন করে হাসপাতাল ফর্মুলারি প্রণয়ন করতে হবে। এই ফর্মুলারির ভিত্তিতে ফার্মাসিস্টরা ওষুধের প্রাপ্যতা, সঠিক সংরক্ষণ, গুদাম ব্যবস্থাপনা (ইনভেন্টরি) এবং নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করবেন, দেশের ওষুধশিল্পে নিয়োজিত সব ফার্মাসিস্টদের জন্য উন্নত বেতন কাঠামো এবং পেশাগত মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে হবে, সারা দেশে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের তত্ত্বাবধানে একটি শক্তিশালী ফার্মেসি সেবা কাঠামো (কমিউনিটি ফার্মেসি নেটওয়ার্ক) গড়ে তুলতে হবে। এই ফার্মেসিগুলোতে ওষুধ পুনর্মূল্যায়ন (রিকনসিলিয়েশন), রোগী পরামর্শ (কাউন্সেলিং) এবং সঠিক বিতরণ কার্যক্রম পরিচালিত হবে। শুধু গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট পরিচালিত প্রতিষ্ঠানকেই ‘ফার্মেসি’ হিসেবে গণ্য করতে হবে এবং সব ফার্মেসিকে জাতীয় নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে হবে, চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ বিক্রি রোধে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে।
‘চিকিৎসাপত্র ছাড়া, ওষুধ নয়’ নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে। আইনগত ব্যবস্থার পাশাপাশি ওষুধ পরিদর্শন (ড্রাগ ইন্সপেকশন) কার্যক্রম জোরদার করা জরুরি। এ জন্য প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টকে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অধীনে ফার্মাসিস্ট প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও আন্তর্জাতিক ফার্মাসিস্ট ফেডারেশনের (এফআইপি) নির্দেশনা অনুযায়ী শুধু ফার্মেসি গ্র্যাজুয়েটরাই ‘ফার্মাসিস্ট’ হিসেবে স্বীকৃত। ২০২৩ সালের ‘ওষুধ ও প্রসাধনী আইন’ অনুযায়ী সরকারি ও বেসরকারি সব নিয়োগে শুধু গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের ‘ফার্মাসিস্ট’ হিসেবে উল্লেখ করতে হবে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মানবসম্পদ ডেটাশিট (এইচআরএইচ ডেটাশিট) ২০২৩ ও ফার্মেসি কাউন্সিলের চার্টারেও বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। সাম্প্রতিক প্রজ্ঞাপন, সার্কুলার ও দাপ্তরিক নথিপত্রেও এই বিষয়টির প্রতিফলন জরুরি। এতে বিভ্রান্তি হ্রাস পাবে, ফার্মাসিস্টদের ভূমিকা সুসংহত হবে এবং জনস্বাস্থ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ ছাড়া, দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মা-ডি কোর্স চালু ও বি.ফার্মসম্পন্নদের জন্য ২ বছরের পোস্ট-ব্যাচেলরিয়েট ফার্মা-ডি কোর্স প্রবর্তন করতে হবে। ফার্মাসিস্টদের জন্য স্ট্যান্ডার্ড বেতন কাঠামো ও পেশাগত স্বীকৃতি নিশ্চিত করারও দাবি জানান তারা।