একসময় সিলেট শহরের গণপরিবহনের মূল মাধ্যম ছিল টাউন বাস ও রিকশা। বর্তমানে সিএনজি অটোরিকশা, যা প্রাইভেট ত্রি-হুইলার হিসেবে নিবন্ধিত হয়ে উঠেছে সিলেটের গণপরিবহন ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সমস্যা। যথেচ্ছ ভাড়া আদায়, যাত্রী হয়রানি এবং প্রশাসনের নীরবতার কারণে নগরবাসীর একরকম জিম্মি।
সিলেট নগরীর যাত্রীদের জন্য সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলোÑ একই দূরত্বে ভাড়া নির্ধারণে ভিন্ন রকম, নেই কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা। উদাহরণস্বরূপ, টিলাগড় থেকে আম্বরখানায় যাওয়ার ভাড়া দিনের বেলায় ২০ টাকা নির্ধারিত থাকলেও উল্টো পথে একই দূরত্বে আসার সময় ভাড়া মাত্র ১৫ টাকা নেওয়া হয়। আবার কামরান চত্বর থেকে টিলাগড় পর্যন্ত ভাড়া দিনে ১৫ টাকা হলেও রাতের বেলায় একই দূরত্বে ২০ থেকে ৩০ টাকা আদায় করা হয়। তা ছাড়া, কামরান চত্বর থেকে রোজভিউ পয়েন্ট (প্রায় ২ কিলোমিটার) ভাড়া ১৫ টাকা, কিন্তু বাস টার্মিনাল (প্রায় ৩ কিলোমিটার) পর্যন্ত ভাড়া ২০ টাকা ধার্য করা হয়Ñ যদিও দূরত্বের বিচারে এই পার্থক্য অপ্রতুল।
আরও অবাক করা বিষয় হলো, সিলেটের বাস টার্মিনাল থেকে খালের মুখ বাজার পর্যন্ত প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরত্বে সিএনজি অটোরিকশার ভাড়া মাত্র ২০ টাকা, যা অনেক ছোট দূরত্বের তুলনায় একই বা কম। এই অসংগতিপূর্ণ ভাড়া নীতির কারণে সাধারণ যাত্রীদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও হতাশা বিরাজ করছে। এবং সিএনজি অটোরিকশা রিজার্ভ নিলে একেকজন একেক রকম ভাড়া আদায় করেন। যেখানে ভাড়া হওয়ার কথা ১০০ টাকা, সেখানে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা ভাড়া নেওয়া হয়। যেটা দেশের অন্যান্য বড় শহরের সিএনজি অটোরিকশার ভাড়ার তুলনায় অনেক বেশি।
তবে এই ভারা নৈরাজ্য থামাতে উদ্যোগী হওয়ার কথা জানিয়েছে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ (এসএমপি)। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে সিলেটে সিএনজি অটোরিকশার ভাড়া নির্ধারণ করা হবে বলে জানিয়েছেন এসএমপি কমিশনার আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী। বলেন, শুধু সড়কে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ানো এবং আইন মানার প্রতি জোর দিচ্ছি তা নয়, একই সঙ্গে যাতে যাত্রীদের অধিকার নিশ্চিত থাকে, সুবিধা নিশ্চিত হয়, সেই উদ্যোগও আমরা নিয়েছি এবং তা বাস্তবায়নও করব।
সূত্র জানায়, দেশের অন্যান্য বড় শহরে সিএনজি অটোচালকেরা মিটারে ভাড়া নেন, কিন্তু সিলেটে এটি প্রায় নেই বললেই চলে। কারণ সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়নি, তাই চালকেরা মিটারের প্রয়োজনীয়তা মনে করেন না। আর মিটার না থাকায় চালকেরা প্রায়ই বেশি ভাড়া দাবি করেন, বিশেষ করে রাতের বেলায় বা বৃষ্টির সময়।
একই রুটে একাধিক যাত্রী থাকলে সিএনজি অটোচালকেরা কিছু যাত্রী নিতে অস্বীকার করেন এবং অন্য গন্তব্যের যাত্রী খুঁজতে থাকেন বেশি ভাড়ার জন্য। অনেক সময় তারা তিন-চার গুণ বেশি ভাড়া দাবি করেন এবং যাত্রীদের ‘রিজার্ভ’ যেতে চাপ দেন। চালকদের এই আচরণের পেছনে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট কাজ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সিলেট মহানগরের টিলাগড় এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা মাহমুদা খাতুন একজন সাধারণ যাত্রী। তিনি বলেন, ‘একই পথে যাওয়া-আসায় ভাড়া এতই পরিবর্তন হয় যে আমরা বুঝতেই পারি না। কখনো বেশি, কখনো কম। রাতে টিলাগড় থেকে কামরান চত্বরে আসতে ২০ টাকা দিতে হয়েছে, আবার দিনে ১৫ টাকা। এটা খুব অন্যায়।’
বন্দরবাজার-মেজর টিলা-বটেশ্বর রোডের সিএনজি অটোরিকশাচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা আমাদের খরচ মাথায় রেখেই ভাড়া নির্ধারণ করি। রাতে যাত্রী কম থাকে, তাই একটু বেশি নিতে হয়। সিলেটে কোনো গাড়িই মিটারে চলে না। সরকার এ বিষয়ে কোনো নীতিমালা আমাদের দেয় নাই। আমরা নিজেরাই ভাড়া নির্ধারণ করি। একই দূরত্বে ভিন্ন ভাড়া কেন জানাতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক সময় যাত্রী কম হয়, তাই এরকম ভাড়া নেওয়া হয়।’
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি (ট্রাফিক) মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে মাঝে মাঝে অভিযান চালানো হয়, কিন্তু সরকারি কোনো নির্দিষ্ট ভাড়ার তালিকা না থাকায় আমরা খুব বেশি কিছু করতে পারি না।’
সিলেটে সিএনজি অটোরিকশা প্রাইভেট ত্রি-হুইলার হিসেবে নিবন্ধিত হওয়ায় সরকারিভাবে তাদের ভাড়া বা পরিচালনা নিয়ন্ত্রণ করা হয় না। এ ছাড়া টাউন বাস ও লেগুনার পর্যাপ্ত সার্ভিস না থাকায় সাধারণ মানুষ বাধ্য হয় সিএনজির ওপর নির্ভরশীল হতে হয়, যা চালকদের ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য ও সিন্ডিকেট করার সুযোগ করে দিয়েছে। সিলেটের অন্যান্য গণপরিবহনের তুলনায় সিএনজির ভাড়া সবচেয়ে বেশি আর অনিয়মের বিষয়টি সবচেয়ে বড়। টাউন বাস ও লেগুনার ভাড়া নিয়ে কিছুটা নিয়মকানুন থাকলেও তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয় না।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, সিলেটের অধিকাংশ সিএনজি অটোরিকশা প্রাইভেট (ব্যক্তিগত ব্যবহারের) জন্য রেজিস্ট্রেশন করা। কিন্তু বাস্তবে সেগুলো যাত্রী পরিবহন করে দৈনিক হাজারো টাকা আয় করছে, যা সরাসরি আইন লঙ্ঘন। একজন সিনিয়র বিআরটিএ কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, ‘আইন অনুযায়ী প্রাইভেট যানবাহনে প্যাসেঞ্জার পরিবহন নিষিদ্ধ। কিন্তু সিলেটে এটা এমন পর্যায়ে গেছে যে স্থানীয় ট্রাফিক বিভাগ চাইলে রাস্তায় প্রায় সব সিএনজি অটোরিকশা আটকাতে পারত। কিন্তু কার্যত কিছুই হচ্ছে না।’
তিনি আরও বলেন, সিএনজি অটোরিকশাচালকদের একাংশ নিজেরাই একটি স্ট্যান্ডভিত্তিক সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। তারা ঠিক করে দেন কোন এলাকায় কী পরিমাণ ভাড়া নিতে হবে। এতে নতুন চালকেরাও বাধ্য হয়ে সেই নিয়মে চলেন।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন