আগামী ত্রয়োদশ নির্বাচন ঘিরে বরিশালের ছয়টি আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী বিএনপি নেতাদের মধ্যে বিভাজনের রেখা স্পষ্ট ছিল। তাদের কর্মী-সমর্থকেরাও কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। বিভাজন একসময় এতটাই প্রকট হয় ওঠে যে, মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বাকযুদ্ধেও জড়িয়ে পড়েন। বাধ্য হয়ে বিএনপির হাইকমান্ড সপ্তাহখানেক আগে বিষয়টি নিয়ে সালিশ করে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার পরামর্শ দেন।
মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতাদের এমন বিভিক্তর মধ্যেই গত সোমবার বরিশালের পাঁচটি আসনে ধানের শীষের প্রার্থী ঘোষণা করে বিএনপি।
বরিশাল-৩ আসন খালি রেখে বাকি পাঁচটিতে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। ঘোষণা অনুযায়ী বরিশাল-১ জহির উদ্দিন স্বপন, বরিশাল-২ সরদার সরফুদ্দিন আহমেদ সান্টু, বরিশাল-৪ মো. রাজিব আহসান, বরিশাল-৫ মো. মজিবর রহমান সরোয়ার এবং বরিশাল-৬ আসনে আবুল হোসেন খান ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ত্রয়োদশ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
ধারণা ছিল, মনোনয়ন না পেলে বরিশাল বিএনপিতে অসন্তোষ বাড়বে। কিন্তু হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তে বিরোধিতার বদলে মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার সিদ্ধান্ত জানা গেছে।
স্থানীয় বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, বরিশাল জেলার ছয়টি আসন থেকেই বিএনপির একাধিক নেতা মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। স্থানীয় রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিরোধও প্রকাশ্য ছিল। উদাহরণস্বরূপ, বরিশাল-২ (উজিরপুর-বানারীপাড়া) এবং বরিশাল-৫ (বরিশাল মহানগর ও সদর) আসনের কথা বলা যায়। বরিশাল-২ আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ছিলেন অন্তত পাঁচজন। তাদের মধ্যে ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার পেয়েছেন সরদার সরফুদ্দিন সান্টু।
বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সান্টু যাতে মনোনয়ন না পান, সে জন্য তার ওপর থেকে দলের হাইকমান্ডের নজর সরাতে মনোনয়নবঞ্চিতদের কেউ কেউ কৌশলও নিয়েছিলেন। বরিশাল-২ আসনে সেই সান্টুকে মনোনয়ন দেওয়ার চূড়ান্ত ঘোষণার পর পাল্টে গেছে উজিরপুর-বানারীপাড়া বিএনপির রাজনীতির মেরুকরণ। মনোনয়নবঞ্চিতদের পাশাপাশি তাদের কর্মী-সমর্থকেরাও এই আসনে সান্টুর ধানের শীষের পক্ষে কাজ করার জোরালো ঘোষণা দিয়েছেন।
বরিশাল-৫ সদর আসনে পাঁচবারের এমপি মজিবর রহমান সরোয়ার ধানের শীষে নির্বাচন করার অধিকার পেয়েছেন। মর্যাদার আসন হিসেবে বিবেচিত এখানে বিএনপির কেন্দ্রীয় মোয়াজ্জেম হোসেন আলালসহ প্রভাবশালী অন্তত হাফ ডজন নেতা মনোনয়ন চেয়েছিলেন। মনোনয়নপ্রাপ্তি নিয়ে নিয়ে তারা নিজেদের মধ্যকার কাদা ছোড়াছুড়ি করতে গিয়ে বিএনপির হাইকমান্ডের শোকজও পেয়েছিলেন।
বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এতটাই বেড়েছিল যে বরিশাল মহানগর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা খানম নাসরিন পিতৃতুল্য মজিবর রহমান সরোয়ারকে নিয়ে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে একাধিকবার নেতিবাচক মন্তব্য করেন। এ নিয়ে বরিশাল বিএনপির রাজনীতিতে উত্তেজনার পারদ ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকলে বিষয়টি হাইকমান্ডের নজরে আসে এবং এক দিনের নোটিশে তাদের সবাইকে রাজধানী ঢাকার গুলশান কার্যালয়ে ডেকে নিতে বাধ্য করেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা।
বিএনপির প্রার্থী ঘোষণার পর বরিশাল মহানগর ও জেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়ে আনন্দ মিছিল করেছেন।
বরিশাল মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব জিয়া উদ্দিন সিকদার জানান, তার আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক এবং সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা খানম নাসরিনও বরিশাল-৫ সদর আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। কিন্তু হাইকমান্ড মজিবর রহমান সরোয়ারকে প্রার্থী ঘোষণা করেছেন, এই সিদ্ধান্ত সবাই মেনে নিয়েছেন এবং নির্বাচনি ফলাফল ঘরে তুলতে শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যায়ের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থেকে ধানের শীষের পক্ষে কাজ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এই আসনে মনোনয়নবঞ্চিত বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আবু নাসের রহমত উল্লাহও অনুরূপ অভিব্যক্তি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, তাদের নেতা বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান এবং ধানের শীষ প্রশ্নে নেতাকর্মী ঐক্যবদ্ধ।
বরিশাল (দক্ষিণ) জেলা বিএনপির সদস্যসচিব আবুল কালাম শাহীন জানান, তিনিও বরিশাল-৫ সদর আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। কিন্তু দল তাকে বঞ্চিত করেছে। এ নিয়ে তার কোনো রাগ বা অনুরাগ নেই। হাইকমান্ডের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন এবং নেতাকর্মীদের ধানের শীষের পক্ষে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভাজিত বরিশাল বিএনপি যে ঐক্যবদ্ধ এবং কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান দেখিয়েছে, তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ইতিবাচক আলোচনা শোনা যাচ্ছে। স্থানীয় নেতাদের এমন আচরণে বিএনপির হাইকমান্ডও খুশি বলে মন্তব্য পাওয়া গেছে।
তবে পূর্বের এই বিভাজন নিয়ে কোনোরূপ মন্তব্য করতে চাইছেন না বরিশাল সদর আসনের প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ার। বর্ষীয়ান এই রাজনৈতিক জানান, নেতা তারেক রহমানের সিদ্ধান্ত সবাই মেনে নিয়েছেন এবং মনোনয়নবঞ্চিতরাও সোমবার সন্ধ্যার পরে তার সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যম যোগাযোগ করেছেন। নির্বাচনে ধানের শীষকে কীভাবে বিজয়ী করা যায়, সবাই সেই লক্ষ্যে কাজ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ আছেন।’

