পৃথিবীর বুকজুড়ে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য রহস্য, যার অনেক কিছুই আজও মানুষের কাছে অজানা। তাই তো প্রকৃতিকে আমরা যতই জানি, ততই নতুন নতুন বিস্ময়ে অবাক হতে হয়। আমরা সাধারণত গাছ বলতে বুঝি সবুজ পাতা, ফুল, ফল আর ছায়া। কিন্তু জানলে বিস্মিত হবেন, পৃথিবীতে এমন এক গাছ আছে যেটি কেটে দিলে বের হয় লালচে রঙের রক্ত। এই অদ্ভুত গাছের নাম ড্রাগন ব্লাড ট্রি বা ড্রাকেনা সিন্নাবারি। ড্রাগন ব্লাড ট্রি পৃথিবীর আর কোথাও নেই, একমাত্র ইয়েমেনের সোকোত্রা দ্বীপপুঞ্জেই এর দেখা মেলে।
আরব সাগরে অবস্থিত এই দ্বীপকে বলা হয় জীববৈচিত্র্যের ভান্ডার। এখানে এমন সব প্রাণী ও উদ্ভিদ জন্মেছে যা পৃথিবীর অন্য কোনো স্থানে নেই। এর মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো ড্রাগন ব্লাড ট্রি। এই গাছের বৈশিষ্ট্যই হলো এর ভেতরে জমে থাকা রক্ত, তবে গাছের এই রক্ত আসলে কোনো প্রাণীর রক্ত নয়, এটি গাঢ় লালচে রেজিন বা গাম। গাছ কেটে দিলে সেই রেজিন তরল আকারে বেরিয়ে আসে। বাইরে থেকে দেখে মনে হয় গাছ যেন রক্তক্ষরণ করছে। এজন্যই এর নাম হয়েছে ড্রাগনের রক্তের গাছ। প্রাচীন যুগ থেকে এ গাছকে ঘিরে নানা লোককথা প্রচলিত ছিল। অনেকের বিশ্বাস ছিল গাছের ভেতরে ড্রাগনের রক্ত রয়েছে, সেই রক্তই গাছকে রহস্যময় করেছে। কেউ কেউ মনে করতেন, কোনো এক সময় ড্রাগনের রক্ত মাটিতে পড়েছিল, আর সেখান থেকেই জন্ম হয়েছিল এ গাছের।
যদিও এসব কেবল বিশ্বাস ও কল্পকথা, তবুও তা গাছটির গুরুত্ব ও রহস্যময়তাকে আরও গভীর করেছে। ড্রাগন ব্লাড ট্রির গঠনও বেশ অদ্ভুত। দূর থেকে দেখতে এটি অনেকটা উল্টানো ছাতার মতো। শাখাগুলো ওপরে উঠে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ে, যেন আকাশে বিশাল ছাতা মেলে দেওয়া হয়েছে। শাখার ডগায় জন্মানো লম্বা ও ধারালো পাতা দেখতে অনেকটা তলোয়ারের মতো। প্রকৃতি যেন বিশেষভাবে সাজিয়ে দিয়েছে এই গাছটিকে। এর অনন্য সৌন্দর্য এবং লালচে রেজিন একে করেছে ভিন্নমাত্রিক। ড্রাগন ব্লাড ট্রির ব্যবহারও যুগ যুগ ধরে মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রাচীন যুগে এর রেজিন ব্যবহার করা হতো চিকিৎসায়। ক্ষত সারাতে, রক্তপাত বন্ধ করতে ও সংক্রমণ ঠেকাতে এই রেজিন কাজে লাগানো হতো।
শুধু চিকিৎসাই নয়, ধর্মীয় আচার ও শিল্পকর্মেও এটি ব্যবহৃত হতো। ধূপ তৈরি করার জন্য এটি ছিল জনপ্রিয় উপাদান। অনেকে বিশ্বাস করতেন, এই ধূপ জ্বালালে অশুভ আত্মা দূরে সরে যায়। ইউরোপে একসময় বাদ্যযন্ত্র পালিশ করার জন্যও ড্রাগন ব্লাড ট্রির রেজিন ব্যবহৃত হতো। এর লালচে চকচকে আবরণ বাদ্যযন্ত্রকে দিত অনন্য সৌন্দর্য। আবার প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যে এটি রং তৈরির কাজে লাগানো হতো। কিছু যুদ্ধাস্ত্র, অলঙ্কার ও মূর্তিকে রঙিন করতে এ রেজিন ব্যবহার করা হয়েছিল।
ফলে দেখা যায়, চিকিৎসা থেকে শুরু করে শিল্প ও সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রে ড্রাগন ব্লাড ট্রির অবদান ছিল অনস্বীকার্য। এখনকার দিনে গবেষকরা এই রেজিনকে বিভিন্ন ভেষজ ওষুধ তৈরিতেও ব্যবহার করছেন। রক্ত জমাট বাঁধা, ক্ষত সারানো বা হজমের সমস্যার মতো নানা চিকিৎসায় এর উপকারিতা পাওয়া যায় বলে প্রমাণ মিলেছে। অর্থাৎ লোকবিশ্বাসের বাইরে আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রেও এটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, এই বিস্ময়কর গাছ বর্তমানে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে। জলবায়ু পরিবর্তন, অতিরিক্ত পশু চরানো, বন উজাড় ও মানবিক আগ্রাসনের কারণে ড্রাগন ব্লাড ট্রির সংখ্যা দ্রুত কমছে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থা (ওটঈঘ) ইতোমধ্যেই এটিকে বিপন্ন তালিকাভুক্ত করেছে।
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, সঠিক উদ্যোগ নেওয়া না হলে আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই হয়তো এই গাছ কেবল ইতিহাসের পাতায় টিকে থাকবে। ড্রাগন ব্লাড ট্রি কেবল একটি গাছ নয়, বরং এটি প্রকৃতির বিস্ময়ের প্রতীক। এ গাছ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে পৃথিবীতে এখনো এমন অনেক রহস্য আছে যা আমাদের অজানা। আমরা বিজ্ঞান দিয়ে অনেক কিছু ব্যাখ্যা করতে পারি, কিন্তু প্রকৃতি মাঝে মাঝে এমন বিস্ময় হাজির করে যা মানুষকে থমকে দেয়।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন