বাংলাদেশে চলচ্চিত্র শিল্প একসময় ছিল সংস্কৃতিচর্চার প্রাণকেন্দ্র। এ শিল্পের মাধ্যমে সমাজের বাস্তবতা, ইতিহাস, প্রেম-দ্বন্দ্ব, এবং নানা মানবিক আবেগ ফুটে উঠত রুপালি পর্দায়। ‘ছবি দেখতে যাওয়া’ ছিল এক পারিবারিক বা সামাজিক অনুষ্ঠান। প্রেক্ষাগৃহে ভিড় জমতো, সিট পেতেও ধরতে হতো লম্বা লাইন। ঢাকার শহরের সিনেমা হল কিংবা মফস্বলের কোনো প্রেক্ষাগৃহ সবখানেই ছিল সিনেমা নিয়ে এক অভূতপূর্ব উন্মাদনা। সেই সময়টাকেই বলা হতো, বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালি দিন।
বাংলা চলচ্চিত্রের এই সোনালি যুগ মূলত শুরু হয়েছিল ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে। পাকিস্তান আমলেও ঢাকাকেন্দ্রিক কিছু চলচ্চিত্র দর্শকের মন জয় করে নিয়েছিল। তবে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েই চলচ্চিত্র শিল্প এক নতুন মাত্রায় প্রবেশ করে। ‘বঙ্গবীর’, ‘সূর্যগ্রহণ’, ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, ‘লাঠিয়াল’ কিংবা ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ এ সময়ের চলচ্চিত্রগুলো কেবল বিনোদনের মাধ্যম ছিল না বরং সামাজিক বাস্তবতা, ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছিল।
৯০-এর দশকের পর থেকে অশ্লীলতা, পেশাদারিত্বের অভাব, রাজনৈতিক প্রভাব এবং স্যাটেলাইট চ্যানেলের আগ্রাসনে সিনেমা হলগুলো একে একে বন্ধ হতে শুরু করে। নিম্নমানের চিত্রনাট্য ও প্রযুক্তির অভাব দর্শকদের বিমুখ করে তোলে। তখন থেকেই বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালি দিন স্মৃতি হয়ে যায়।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের মানোন্নয়ন মেধা ও সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছর থেকে শুরু হয়েছিল সরকারি অনুদান।
এই অনুদান চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী ব্যক্তিদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা প্রদান করে, যা চলচ্চিত্র শিল্পকে সমৃদ্ধ করতে সহায়ক। মাঝ খানে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এই অনুদান বন্ধ ছিল, তবে ২০০৭-০৮ অর্থবছর থেকে এটি আবার নিয়মিতভাবে দেওয়া শুরু হয়েছে।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সময়ে ও পারিপার্শ্বিক কারণে অনুদান প্রদান বন্ধ থাকতে দেখা গেছে। তা ছাড়া অনুদান দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রার্থীদের যথাযথ মূল্যায়ন না করে রাজনৈতিক কারণ ও অসঙ্গতির হয়েছে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে নানা সময়।
রূপালী বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিবেদনে চলচ্চিত্রের অনুদানের অর্থ নয়ছয়ের চিত্র ম্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। প্রতিবেদনে একাধিক অসঙ্গতি ফুটে ওঠে। এতে বলা হয়, চলচ্চিত্র নির্মাণে রাষ্ট্রীয় অর্থকোষ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে, এর ফলাফল কী এবং দর্শকের প্রাপ্তি কতটা, সেই প্রশ্ন থেকে যায়। সত্তরের দশক থেকে আজ পর্যন্ত অসংখ্য চলচ্চিত্রের জন্য সরকারি অনুদান বরাদ্দ হলেও এর মধ্যে কতটি আলোর মুখ দেখেছে, এই সংখ্যা নিয়ে আছে বিতর্ক; এই উদ্যোগ নিয়েও দেখা দিয়েছে সংশয়। কোনো কোনো চলচ্চিত্র শুধু লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনের পর প্রথম টেক পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থেকেছে! শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ৬৫টি অনুদানের সিনেমা মুক্তি পায়নি। আরও অবাক করা তথ্য হলো, অনুদানের অর্থ লুটের কোনো হিসাব নেই মন্ত্রণালয়ে। প্রতি সরকারের আমলেই এ অনুদান নিয়ে স্বজনপ্রীতির প্রশ্ন উঠেছে। সেই সঙ্গে অযোগ্য নির্মাতারাও লবিং করে পেয়েছে অনুদান। যার কারণে আগ্রহ হারাচ্ছে দর্শক ও হল মালিকরা।
আগের সব অভিযোগ ছাপিয়ে চলতি অর্থবছরে অনুদান নিয়ে তৈরি হয়েছে মহাবিতর্ক। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১৩ কোটি টাকা সরকারি অনুদান পাচ্ছে ৩২ চলচ্চিত্র। অনুদানের প্রজ্ঞাপন প্রকাশ্যে আসতেই তৈরি হয় বিতর্ক, যা বিগত দিনের সব বিতর্ককে উতরে গেছে। এবারই প্রথমবারের মতো তালিকায় ছিল না কোনো পরিচালকের নাম। এ ছাড়া যেসব নির্মাতা অনুদান পেয়েছেন, তাদের নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন।
প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা সিনেমার অনুদান হিসেবে বরাদ্দ দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য থাকে ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং গুণগত মানের উন্নয়ন। কিন্তু বাস্তবতা হলো- বহু অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র শুরুই হয় না বা একবার শুটিং করেই মুখ থুবড়ে পড়ে। আবার অনেক সময় নামমাত্র বাজেট দেখিয়ে অনুদান আত্মসাৎ করা হয়। এসব চলচ্চিত্রের বেশির ভাগই পরবর্তী সময়ে মুক্তি পায় না, দর্শকের কাছেও পৌঁছায় না। ফলে অনুদানের টাকায় নির্মিত সিনেমাগুলো হয়ে ওঠে কেবল কাগুজে পরিকল্পনা।
এ পরিস্থিতি বন্ধ না হলে একদিকে যেমন রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় হবে, অন্যদিকে চলচ্চিত্র জগতে কাজ করতে ইচ্ছুক প্রকৃত মেধাবীদের সুযোগ প্রাপ্তি বন্ধ হয়ে যাবে। একটি শিল্প ধ্বংসের জন্য এর চেয়ে বড় দুঃসংবাদ আর কী হতে পারে?
আমরা আশা করব, সরকারকে অবিলম্বে অনুদান ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে, একটি পূর্ণাঙ্গ নিরীক্ষা কাঠামো চালু করবে, যেখানে অনুদানপ্রাপ্ত প্রতিটি প্রজেক্টের অগ্রগতি নিয়মিত পর্যালোচনা করা হবে। প্রয়োজনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে উদাহরণ সৃষ্টি করবে। সেই সঙ্গে অনুদানের প্রাপ্যতা নির্ধারণে আরও কঠোর ও পেশাদার মানদ- অনুসরণে গুরুত্ব দেবে।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, চলচ্চিত্র কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি জাতির চেতনা ও ইতিহাসের বাহক। তাই এ শিল্পে দুর্নীতি ও নয়ছয়ের কোনো স্থান থাকা উচিত নয়। চলচ্চিত্র শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে হলে, আগে এর অনুদান ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করতেই হবে।