রবিবার, ০৩ আগস্ট, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

প্রকাশিত: আগস্ট ৩, ২০২৫, ১২:৩৬ এএম

মানব পাচার প্রতিরোধ করা আমাদের দায়িত্ব

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

প্রকাশিত: আগস্ট ৩, ২০২৫, ১২:৩৬ এএম

মানব পাচার প্রতিরোধ করা আমাদের দায়িত্ব

বিশ্বজুড়ে যে অমানবিক অপরাধটি নীরব ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে, তা হলো মানব পাচার। জাতিসংঘ ঘোষিত ৩০ জুলাই পালিত হয় বিশ্ব মানব পাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে।  দিনটি মানব পাচারের ভয়াবহতা সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের অঙ্গীকার স্মরণ করিয়ে দেয়। উন্নত হোক বা অনুন্নত-প্রায় প্রতিটি দেশই কোনো না কোনোভাবে মানব পাচারের শিকার, উৎস বা গন্তব্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

মানব পাচার বলতে বোঝায়, জোরপূর্বক বা প্রতারণার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণে এনে শ্রম, যৌন বাণিজ্য বা অঙ্গ প্রতিস্থাপনসহ নানা নিষিদ্ধ কাজে ব্যবহার করা। এটি শুধু ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও মর্যাদার চরম লঙ্ঘন নয় বরং মানবাধিকারের ভয়াবহ অবমাননা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাচারের শিকার হয় নারী, শিশু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী।
মানব পাচার আজ বহুরূপী এক বৈশ্বিক সংকট। এর মধ্যে অন্যতম হলো- যৌন বাণিজ্যের জন্য পাচার, জোরপূর্বক শ্রমে নিয়োজিতকরণ, বিয়ের নামে প্রতারণা করে পাচার, অঙ্গ পাচার, গৃহকর্মে জবরদস্তিমূলক নিয়োজিতকরণ, শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তিতে বাধ্য করা, অবৈধ দত্তক বা শিশু পাচার জাতিসংঘের মতে, প্রতিবছর লক্ষাধিক মানুষ পাচারের শিকার হন। বিশ্বজুড়ে মানব পাচারের ৭০ শতাংশ শিকার নারী ও শিশু। ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল এ সমস্যায় অধিক ভুক্তভোগী। পাচারকারীরা সংঘবদ্ধ চক্র হিসেবে কাজ করে এবং প্রায়ই তাদের সঙ্গে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনের যোগাযোগ থাকে।
বাংলাদেশ একটি উৎস ও ট্রানজিট দেশ হিসেবে পরিচিত। প্রতিনিয়ত দারিদ্র্য, শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব, এবং কর্মসংস্থানের সংকটের কারণে বহু নারী-পুরুষ প্রতারণার ফাঁদে পড়ে বিদেশে কর্মসংস্থানের আশায় পাচারের শিকার হন। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে নারী গৃহকর্মীদের ওপর শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে।

> মানব পাচারের কারণ
১. দারিদ্র্য ও বেকারত্ব
২. অশিক্ষা ও সচেতনতার অভাব
৩. অবৈধ অভিবাসনের আকাক্সক্ষা
৪. লাভের আশায় পরিবার বা আত্মীয়ের যোগসাজশে পাচার
৫. প্রতারণামূলক কর্মসংস্থানের বিজ্ঞাপন
৬. প্রশাসনিক দুর্বলতা ও দুর্নীতি

মানব পাচারকারীরা বিভিন্ন ছলচাতুরি, প্রতিশ্রুতি, প্রেমের ফাঁদ, ফেক ভিসা বা এজেন্সির মাধ্যমে মানুষকে ফাঁদে ফেলে। কখনো কখনো পরিবার কিংবা আত্মীয়স্বজনও এর পেছনে জড়িত থাকে।

মানুষ পাচারের শিকার হলে তারা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের সম্মুখীন হয়, নারীরা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, শিশুদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে যায়, পরিবারে দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক কলঙ্ক দেখা দেয়, পাচার হওয়া ব্যক্তি দেশে ফিরে এলে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা হারায়।

জাতিসংঘের ‘প্রোটোকল টু প্রিভেন্ট, সাপ্রেস অ্যান্ড পানিশ ট্রাফিকিং ইন পারসনস, স্পেশালি উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন’, যা পালেরমো প্রোটোকল নামে পরিচিত, এটি মানব পাচার প্রতিরোধে একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক দলিল।

এ ছাড়া রয়েছে ILO (International Labour Organization এর আইন, UNODC এর ট্রাফিকিং ইন পার্সনস রিপোর্ট, UNICEF  এর শিশু সুরক্ষা নীতি, INTERPOL -এর মানব পাচারবিরোধী যৌথ অপারেশন বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালে ‘মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন’ পাস করে।

এ ছাড়া রয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন এনজিও যেমন BRAC, Ain, Salish Kendra, RMMRU , ট্রাফিকিং ইন পার্সনস সেল গঠন, সংশ্লিষ্ট থানায় হেল্প ডেস্ক চালু, দূতাবাসে হটলাইন ও আইন সহায়তা। তবে বাস্তবায়নের ঘাটতি এবং বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

মানব পাচার প্রতিরোধে সর্বপ্রথম প্রয়োজন সচেতনতা। জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য গ্রামপর্যায়ে প্রচারাভিযান, স্কুল-কলেজে সচেতনতামূলক ক্লাস, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তথ্য প্রচার, টিভি-রেডিও নাটক ও বিজ্ঞাপন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্ততা তরুণ সমাজ মানবপাচার প্রতিরোধে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তারা বন্ধু ও পরিবারকে সচেতন করতে পারে, পাচারকারীদের চেনার কৌশল শিখতে পারে, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে প্রচার চালাতে পারে , আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে পারে।

পরিশেষে বলতে চাই, মানব পাচারের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এ জঘন্যতম অপরাধটি কোনো একক ব্যক্তির পক্ষে করা সম্ভব নয়। এই অপরাধের পেছনে থাকে বিশাল এক চক্র। যে দেশগুলোয় মানব পাচার হয়, সেই দেশের দালালদের মধ্যে থাকে যোগসূত্র। দলবদ্ধ পরিকল্পনার মাধ্যমে অপরাধটি সংঘটিত হয়। একটি তদন্তে উঠে আসে, মানব পাচার হয় মৌসুম হিসাব করে। পাচারকারীরা একটি মৌসুম নির্বাচন করে, সেই অনুযায়ী পাচার করে মানুষকে। তারা হেমন্ত ও শীতকালকে পাচারের মৌসুম হিসাবে ধরে, কারণ এ সময় সমুদ্র কিছুটা শান্ত থাকে, তাই তারা ছোট ছোট নৌকা করে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে মানব পাচার করে। আর মানব পাচার কমিয়ে আনতে রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টাই যথেষ্ট নয়। আমাদের উচিত বিদেশে যাওয়ার আগে সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলো যাচাই করা; অবশ্যই নিয়োগপত্র, নিয়োগদাতা ও প্রতিষ্ঠান, ভিসা ইত্যাদি যাচাই করা; বৈধ এজেন্সির সহায়তা নেওয়া এবং কাগজপত্রের কয়েক কপি নিকটাত্মীয়ের কাছে রেখে যাওয়া। সর্বোপরি এ ধরনের অপরাধে যারা জড়িত, তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা। এ ছাড়া পাচারের শিকার ব্যক্তিদের সমাজে পুনরেকত্রীকরণে সহায়তা করা। আর মানব পাচার কেবল একটি অপরাধ নয়, এটি মানবতা, সভ্যতা এবং নৈতিকতার বিরুদ্ধে এক ভয়াবহ আগ্রাসন। শুধু আইন করেই এই ভয়াবহতা বন্ধ করা যাবে না; প্রয়োজন সম্মিলিত সামাজিক প্রতিরোধ ও মানবিক দায়িত্ববোধ। এই বিশ্ব মানব পাচার প্রতিরোধ দিবসে আসুন আমরা একসঙ্গে প্রতিজ্ঞা করি, একজন মানুষও যেন আর পাচারের শিকার না হয়।

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ লেখক, সংগঠক, কলাম লেখক ও গবেষক

Shera Lather
Link copied!