ঢাকা শুক্রবার, ২২ আগস্ট, ২০২৫

রাজনৈতিক স্বার্থে ইতিহাস বিকৃত : রাষ্ট্রের দায়

হুমায়ুন আহমেদ নাইম
প্রকাশিত: আগস্ট ২২, ২০২৫, ০৮:১৭ এএম

ইতিহাস একটি দেশের আত্মপরিচয়ের আয়না। অতীতের সঠিক বিবরণ একটি জাতিকে তার ভুল থেকে শিক্ষা নিতে, অর্জনকে উদযাপন করতে এবং ভবিষ্যতের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমাদের দেশে ইতিহাস সত্যের ভিত্তিতে লেখার পরিবর্তে রাজনৈতিক স্বার্থের ভিত্তিতে লেখা হয়। ক্ষমতার পালাবদল হলে পাঠ্যপুস্তকের পাতা, জাতীয় দিবসের তালিকা, এমনকি নায়কও বদলে যায়। এই ধরনের অসুস্থ মানসিকতা আমাদের জাতিগত মূর্খতার প্রমাণ বহন করে।

বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ইতিহাসকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করেছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসই তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। কোন নেতা কী ভূমিকা রেখেছেন, কার অবদান সবচেয়ে বেশি- এসব নিয়ে বিতর্কের যেন শেষ নেই! যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, সে সরকারই অন্যদের অবদানকে আড়াল করে নিজেদের কৃতিত্বকে বড় করে দেখিয়েছে। আবার ক্ষমতার পালাবদলে সেই বিবরণও উল্টে গেছে বারবার। ফলে একই ইতিহাসের দুটি বা ততোধিক সংস্করণ তৈরি হয়েছে, যেগুলোর মাঝে বিরোধ এত তীব্র যে নতুন প্রজন্ম সত্য-মিথ্যার ফারাকই বুঝতে পারছে না। ফলে জাতীয়তা বোধের মাঝেই তৈরি হচ্ছে সন্দেহ। যার ফলে একদল অন্যদলকে বিরোধী দল না ভেবে ভাবছে শত্রু দল। ফলে সমাজসহ সারা দেশেই সহিংসতার পরিমাণ বেড়ে চলছে।

বিকৃত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে জাতীয় ঐক্যের ভাঙন। যখন এক দল বলে আমার নেতাই ছিল প্রকৃত নায়ক, আবার অন্য দল দাবি করে, না! আমাদের নেতাই ছিলেন ত্রাণকর্তা। তখনই জনগণের মধ্যে বিভক্তির তৈরি হয়। ইতিহাসকে দলীয় অস্ত্র বানিয়ে ব্যবহার করলে সাধারণ মানুষ সেই দলীয় অস্ত্রের বলি হয়। ফলে নাগরিক সমাজে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহমর্মিতা কমে যায়, আর রাজনৈতিক বিভাজন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে।

ইতিহাস বিকৃতির সমস্যা শুধু রাজনৈতিক বিতর্কেই সীমাবদ্ধ নয় বরং এটি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার উপরও গভীরভাবে প্রভাব ফেলছে। স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস এমনভাবে লেখা হয়, যেন বর্তমান সরকারই দেশের একমাত্র ত্রাণকর্তা। গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর প্রকৃত প্রেক্ষাপট বাদ দিয়ে, নির্বাচিত দলের অবদান তুলে ধরা হয়। এর ফলে শিক্ষার্থীরা একপাক্ষিক ধারণা পাচ্ছে; যা তাদের সঠিক ইতিহাস জানা থেকে বিরত রাখছে।

বিকৃত ইতিহাসের আরেকটি ভয়ঙ্কর দিক হলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারানো। যখন বিদেশি ইতিহাসবিদরা আমাদের ইতিহাসের একাধিক তা আবার বিরোধপূর্ণ সংস্করণ খুঁজে পান, তখন তারা আমাদের ইতিহাসভিত্তিক গবেষণা ও তথ্যের উপর আস্থা রাখেন না। যা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং জাতীয় মর্যাদাকে বিশ্বমঞ্চে হেয় করছে।

’২৪-এর জুলাইকে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক করা মোটেও সমীচীন নয়। আমাদের ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬৬-এর ছয় দফা, ’৭০-এর নির্বাচন এবং ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। প্রতিটি ঘটনাই একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রতিটি ঘটনায় নেতৃত্ব দেওয়া নেতা (মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান) প্রমুখ সবাই জাতীয় বীর। এখন ’২৪-এর জুলাই আন্দোলনের সমন্বয়ক যারা ছিল, তারা যদি ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে কোনো হীনপ্রচেষ্টা বাস্তবায়ন করে, তাহলে জুলাই ’২৪-এর ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা কতটুকু যৌক্তিক? একইভাবে মুক্তযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে প্রশ্নবিদ্ধ করাটাও কতটুকু যৌক্তিক?

ইতিহাসকে সরকারি প্রভাবমুক্ত করতে হবে। ইতিহাস লেখার দায়িত্ব সরকার নিয়ন্ত্রিত নয়, বরং স্বাধীন কমিশনের হাতে থাকা উচিত। এই কমিশনে বহুদলীয় প্রতিনিধিত্বের পাশাপাশি কোনো রাজনৈতিক দলের সক্রিয় সদস্য নয় এমন পেশাদার ইতিহাসবিদদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে ইতিহাস রচনায় নিরপেক্ষতা বজায় থাকে।

এ ছাড়া পাঠ্যপুস্তকে শুধু সরকারি বিবরণ নয়, বরং বহুমাত্রিক ও প্রামাণ্য উৎসের তথ্য যুক্ত করা জরুরি। গবেষণালব্ধ তথ্য, বিদেশি নথি, প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাৎকার এবং আন্তর্জাতিক গবেষণার ফলাফল অন্তর্ভুক্ত করে শিক্ষার্থীদের একাধিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলনা করার সুযোগ দেওয়া উচিত। এতে তারা সমালোচনামূলকভাবে সত্য-মিথ্যা বিচার করতে শিখবে।

গণমাধ্যমও এখানে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও অনলাইন মিডিয়ায় ইতিহাসভিত্তিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রচার করতে হবে, যেখানে প্রমাণভিত্তিক তথ্য উপস্থাপন করা হবে। বিতর্কিত ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে ওপেন ডিবেট ও টকশোর আয়োজন করলে জনগণ ভিন্নমতের সঙ্গে পরিচিত হতে পারবে।

স্পষ্ট ইতিহাসই জাতির ভিত্তি। ইতিহাস হবে সকল জনতার মূল্যবোধ, ঐক্যের প্রধান উৎস। কোনো সরকারের ইচ্ছানুযায়ী ইতিহাস পরিবর্তন করা দেশের জন্যই হুমকি। ইতিহাস সরকারের নয়, ইতিহাস হোক আমজনতার।

হুমায়ুন আহমেদ নাইম 
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়