বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে ব্যাংক খাতের ভূমিকা অপরিসীম। শিল্প, কৃষি, ব্যবসা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ সব অর্থনৈতিক কার্যক্রমেই ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ রয়েছে। কিন্তু উদ্বেগজনক বিষয় হলো, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাংক খাতটি নানা ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি, খেলাপি ঋণ এবং প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্যের কারণে এক ধরনের সংকটের মুখে পড়েছে।
বুধবার রূপালী বাংলাদেশের ‘দ্য ব্যাংক অব ইকবাল পরিবার’ শিরোনামের বিশেষ প্রতিবেদনে ডা. এইচবিএম ইকবালের নেতৃত্বে প্রিমিয়ার ব্যাংকে সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতি ও আত্মসাৎ সংক্রান্ত তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে একটি ব্যাংকের নেতৃত্বে থেকে তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা যে ধরনের দাপট ও নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছিলেন, তা ব্যাংক খাতের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর। নিজের মালিকানাধীন ভবন অতি উচ্চ ভাড়ায় ব্যাংকের কাছে ভাড়া দেওয়া, অসম্পূর্ণ ফ্লোরের ভাড়া বাবদ কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া, পরিবারের একাধিক সদস্যকে পরিচালনা পর্ষদে বসানো এবং ঋণ বিতরণে অনিয়মসহ নানা বিষয়। যা দেশের ব্যাংক খাতের স্বচ্ছতা ও সুশাসনের ঘাটতির নগ্ন চিত্র ফুটিয়ে তোলে।
বাংলাদেশ ব্যাংক, আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রতিটি নিয়ন্ত্রক সংস্থাই এ ধরনের অনিয়ম সম্পর্কে অবগত ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বরং রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে ডা. ইকবাল একাধিকবার সংসদ সদস্য হয়েছেন, এমনকি রক্তক্ষয়ী ঘটনার সঙ্গেও তার নাম জড়ালেও আইনের আশ্রয়ে থেকে খালাস পেয়েছেন। এটি শুধু একটি ব্যক্তির দুর্নীতির কাহিনি নয়, বরং গোটা ব্যাংক খাতের দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রতিফলন।
ব্যাংক খাত হলো অর্থনীতির রক্তস্রোত। এখানে আস্থার সংকট তৈরি হলে আমানতকারী ও বিনিয়োগকারীরা মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ে। প্রিমিয়ার ব্যাংকের ভাড়ার জালিয়াতি, ঋণ তথ্য গোপন, অতিরিক্ত ব্যয় ও ফাউন্ডেশনের অর্থ আত্মসাৎ প্রমাণ করে যে, কার্যকর জবাবদিহিতার অভাব কীভাবে একটি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়। এ ধরনের অনিয়ম শেষ পর্যন্ত পুরো ব্যাংকিং খাতকে ঝুঁঁকির মুখে ঠেলে দেয়।
এই অবস্থার পরিবর্তনে জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। প্রথমত, বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্ষমতা ও স্বাধীনতা আরও বাড়াতে হবে, যাতে তারা যথাযথভাবে তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। দ্বিতীয়ত, ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একটি পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। পাশাপাশি বড় ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীন ও দৃঢ়ভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবারের একাধিক সদস্য বসানো বন্ধ করতে হবে। ভাড়া, ঋণ ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত সব তথ্য সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে।
আমরা মনে করি, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করতে হলে ব্যাংক খাতে আস্থা ফিরিয়ে আনা ছাড়া উপায় নেই। এজন্য অনিয়মকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও কঠোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
আমরা আশা করব, প্রভাবশালী যতই শক্তিশালী হোক, ব্যাংক খাত যেন আর কারো ব্যক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধির হাতিয়ার না হয় সে ব্যাপারে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে যাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন