দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ হলো জাতির অপরিমেয় ধন। এগুলো রক্ষা ও সংরক্ষণ করে সঠিক ব্যবস্থাপনায় ব্যবহার করাই উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির ভিত্তি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ লুটপাটের খবর জনমনে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। সিলেটের ভোলাগঞ্জে সাদা পাথর লুটের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই সামনে এলো কোম্পানীগঞ্জের শাহ আরেফিন টিলায় পাথর ও বালু হরিলুটের খবর।
রূপালী বাংলাদেশের ‘কোদালের কোপে খ- খ- টিলা’ শিরোনামের বিশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে শাহ আরেফিন টিলার লুটপাটের খবর। প্রতিবেদনে বলা হয়, জেলার ভোলাগঞ্জের সাদাপাথরের পাথর লুটের ঘটনায় উদ্ধার তৎপরতায় যখন ব্যস্ত প্রশাসন, তখন অনেকটা প্রকাশ্যেই হরিলুট চলছে কোম্পানীগঞ্জের শাহ আরেফিন টিলায়। অথচ এ নিয়ে পরিবেশকর্মীদের প্রতিবাদ ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের পরও নির্বিকার প্রশাসন।
এই লুটপাটে জড়িয়েছেন স্বয়ং শাহ আরেফিন (রহ.)-এর মাজারের খাদেমের উত্তরাধিকারী আব্দুল মান্নান ফকিরের বংশধররা। তাদের রয়েছে শক্তিশালী একটি গোষ্ঠী। তাদের আত্মীয়স্বজন সেখানে পাথর লুট করতে গড়ে তুলেছেন সিন্ডিকেট। সেই সিন্ডিকেটের রয়েছে ১৯ সদস্যের শক্তিশালী বাহিনী। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও বিএনপির নেতাকর্মীরা।
সম্প্রতি শাহ আরেফিন টিলায় দেখা যায়, সেখানকার করুণ চিত্র। একসময়ের টিলাঘেরা এলাকা এখন বিরানভূমি। সরকার পরিবর্তনের পর গত এক বছরে টিলা এলাকা ধ্বংস করা হয়েছে। এখন চারদিকে খ- খ- পুকুর। যেন রীতিমতো সমুদ্রে পরিণত করা হয়েছে পুরো শাহ আরেফিন টিলা এলাকা।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাদাপাথর নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বলে প্রশাসনসহ সবার চোখ সে দিকে। তদন্ত কমিটি হচ্ছে, পাথর ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টাও চলছে। অথচ একটি বিশাল পাহাড়ঘেরা অঞ্চল পাথরখেকোরা গিলে ফেলল, এ নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। উদ্ধারের কোনো উদ্যোগই নেই। দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তিরও কোনো তোড়জোড় নেই। এটি রহস্যজনক। পরিবেশ নিয়ে এরকম দ্বিমুখী নীতি গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রকৃতির এই অপূরণীয় ক্ষতি শুধু পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য নয়, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষতিরও সূচনা। মাজার ও মসজিদসহ টিলাটির ঐতিহাসিক স্থাপনা বিলীন হওয়ার পথে; আর একদিকে বালু-পাথরের লুটপাটে সৃষ্টি হচ্ছে বিশাল গর্ত, যা আগামীর জন্য পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার ইঙ্গিত বহন করে। প্রশাসন ও সরকারের গাফিলতির কারণে এই লুটেরা সিন্ডিকেট দিন দিন শক্তিশালী হয়ে উঠছে, যার নেতৃত্বে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা জড়িত। এ অবস্থা দ্রুত দমন করা না গেলে দেশের প্রকৃতি ও সংস্কৃতি চিরতরে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে এখনই দায়িত্ব নিতে হবে। পর্যটন ও পরিবেশ রক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে শাহ আরেফিন টিলাসহ দেশের অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পুনরুদ্ধারে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। অবৈধ পাথর-বালু উত্তোলন বন্ধে কঠোর নজরদারি ও আইন প্রয়োগ জরুরি। রাজনৈতিক নেতাদের নামে অভিযোগ থাকলে অবিলম্বে তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়ের বেশ কয়েকটি ঘটনা থেকে থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি, যদি সম্পদ সংরক্ষণে অবহেলা করা হয়, তার ক্ষতিপূরণ পরবর্তী সময়ে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তাই দেশের প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক সম্পদ রক্ষায় সরকারের পাশাপাশি সচেতন নাগরিক সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে। সংবাদমাধ্যম ও পরিবেশকর্মীরা এ বিষয়ের প্রতি অধিক মনোযোগ দিচ্ছেন, যা প্রশংসনীয়। তবে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে এ প্রতিবেদন ও প্রতিবাদ কখনোই ফলপ্রসূ হবে না।
আমরা মনে করি, দেশের প্রকৃতিকে রক্ষায় রাষ্ট্রের পাশাপাশি আমাদের সবার দায়িত্ব রয়েছে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক যেন চিরস্থায়ী হয়, তার জন্য অতি দ্রুত কঠোর ও টেকসই পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। যত দ্রুত প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষাায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে, ততই পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকবে, যা আগামী প্রজন্মের জন্য একটি সুস্থ ও নিরাপদ বাংলাদেশ গড়তে সহায়তা করবে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন