ঢাকা সোমবার, ০১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

মতামত

বিএনপির কাছে জনগণের প্রত্যাশা

অরণ্য পাশাপ
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১, ২০২৫, ০৯:৫৩ এএম
ছবি- রূপালী বাংলাদেশ গ্রাফিক্স

সমাজবিজ্ঞানী স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন বলেন, ‘কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের জন্ম হয় তখনই, যখন বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামো সমাজের অন্তর্গত চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়।’ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক শূন্যতা ও নেতৃত্ব সংকট তৈরি হয়েছিল, তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপির আবির্ভাব ঘটে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বারিংটন মুর যেমন বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্র টিকে থাকে তখনই, যখন শাসকগোষ্ঠী ও জনগণের মধ্যে ন্যূনতম সমঝোতা ও বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত হয়’, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে সেই সমঝোতার ঘাটতি ছিল প্রবল। ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছিল সীমিত গোষ্ঠীর হাতে, রাজনৈতিক বহুত্ববাদ উপেক্ষিত হচ্ছিল, আর জনগণের অংশগ্রহণ ক্রমেই কমে যাচ্ছিল। এর ফলে নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ছিল অবশ্যম্ভাবী।

এই প্রেক্ষাপটে বিএনপির জন্ম কেবল একটি দল গঠনের ঘটনা নয়; বরং তা ছিল বহুমাত্রিক রাজনৈতিক দাবির প্রতিফলন, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, এবং অর্থনৈতিক-সামাজিক অন্তর্ভুক্তির আকাক্সক্ষার প্রকাশ।

বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে ১৯৭৮ সাল একটি তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। সেই বছর ১ সেপ্টেম্বর শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান একটি নতুন রাজনৈতিক দলের জন্ম দেন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। এর আগে তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে সামরিক শাসনকে বেসামরিক রূপ দেওয়ার প্রয়াস চালান এবং ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ ধারণাটি সামনে এনে একটি রাজনৈতিক ভিত্তি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন।

১৯৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, হত্যাকা- ও সামরিক শাসনের পেক্ষাপটে দেশের মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী শাসনে জনআস্থার সংকটে ভুগছিল, আর বামপন্থি ও অন্যান্য ক্ষুদ্র দলগুলো জনভিত্তি ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। এ অবস্থায় রাষ্ট্রপতি জিয়া বুঝতে পারেন, দীর্ঘস্থায়ী ক্ষমতার জন্য তাকে একটি শক্ত রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে হবে। তাই প্রথমে তিনি ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন, পরে গঠন করেন জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল)। খুব দ্রুতই সেই দল বিলুপ্ত করে তার জায়গায় গড়ে তোলা হয় বৃহত্তর জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপি।

১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর রমনা রেস্তোরাঁয় আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির ঘোষণা আসে। প্রথম আহ্বায়ক কমিটিতে ছিলেন ১৮ জন সদস্য। অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে মহাসচিব করা হয়। মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দলটির সংবিধান তৈরি হয়, অঙ্গসংগঠন গড়ে ওঠে, যুবদল, ছাত্রদল, মহিলা দল ইত্যাদি। বিএনপিকে বলা যায় ‘বিগ টেন্ট পার্টি’, যেখানে বাম, ডান, কেন্দ্রীয় বিভিন্ন ধারার মানুষকে এক ছাতার নিচে আনা হয়েছিল। প্রাক্তন আমলা, মুক্তিযোদ্ধা, ব্যবসায়ী, এমনকি ভিন্ন মতাদর্শের রাজনীতিকও এতে যুক্ত হন।

বিএনপির আদর্শিক ভিত্তি ছিল ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’। সংবিধানের চার নীতি, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র এবং আল্লাহর প্রতি অটল বিশ্বাস,কে সামনে রেখে দলটি এগোয়। তবে বাস্তব প্রয়োগে বিএনপি মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করে। 

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব রাষ্ট্র ও জাতি গঠনের পরিবর্তে ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীগত লক্ষ্য অর্জনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। জাতীয় সরকারের ধারণাকে অগ্রাহ্য করে বাকশালের প্রতিষ্ঠা, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ১৯৭৫ সালের আগস্টের বিয়োগান্ত ঘটনার মধ্য দিয়ে সামরিক শাসনের সূচনা হয়, যা গণতান্ত্রিক বিকাশের জন্য অনুকূল ছিল না। রাষ্ট্রিক শূন্যতার সেই সময় সিপাহি-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন এবং রাষ্ট্রগঠনের নতুন দিকনির্দেশনা দেন।

শহিদ জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক দল গঠনের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী চেতনায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। বিএনপির গঠনতন্ত্রের মূল লক্ষ্য ছিল, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদভিত্তিক ঐক্য গড়ে তুলে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও গণতন্ত্র সংরক্ষণ করা। দলের রাষ্ট্রিক গন্তব্য কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতা নয়, বরং গণতন্ত্রকে সমাজের মৌলিক স্তরে প্রোথিত করা। এই ভাবনা থেকেই জিয়া কাঠামোগত উন্নয়ন, নাগরিক পরিচয়ের পুনঃসংজ্ঞা, অর্থনৈতিক বিরাষ্ট্রীয়করণ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বহুমুখী বিস্তারে মনোযোগ দেন।

শহিদ জিয়াউর রহমান অতীতের রাজনৈতিক গতানুগতিকতা ভেঙে জনগণকেন্দ্রিক কর্মসূচি হাতে নেন। খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ করার উদ্যোগ, খাল কাটা, জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি, নিরক্ষরতা দূরীকরণে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পৃক্তকরণ এবং যুবসমাজকে কর্মমুখী করা ছিল তার বাস্তবমুখী পরিকল্পনা। জাতীয় নিরাপত্তার জন্য গঠিত গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীকে অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নাগরিক সেনাবাহিনী গঠনের প্রাথমিক রূপ হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। ১৯ দফা কর্মসূচির মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্র পুনর্গঠনের একটি সুদূরপ্রসারী ভিশন উপস্থাপন করেছিলেন, যা বিএনপির মূল ভিত্তি হয়ে ওঠে।

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিএনপি সরকার ও বিরোধী দল, উভয় ভূমিকায় রাষ্ট্রীয় রাজনীতিতে সক্রিয় থেকেছে। সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত তারা নিরবচ্ছিন্ন ভূমিকা পালন করেছে। গুম, খুন, নির্যাতন ও দীর্ঘ দমননীতির মধ্য দিয়েও দলটি টিকে আছে এবং সংগঠনকে শক্তিশালী করেছে। তবে তাদের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন সংগঠনে ব্যর্থতার অভিযোগ রয়েছে। তবু আন্দোলন-সংগ্রাম ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে বিএনপি গণভিত্তি শক্তিশালী করেছে এবং বিরোধী রাজনীতিকে কার্যকর রেখেছে।

আজকের বাংলাদেশ এক অন্তর্বর্তী সময়ে দাঁড়িয়ে। জনগণের প্রত্যাশা বিএনপির কাছে কেবল ক্ষমতার পরিবর্তন নয়, বরং রাষ্ট্র ও রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন। ভিশন’২০৩০ ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিএনপি গণদাবিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি জানিয়েছে। আগামীতে নির্বাচিত হয়ে তারা যদি জিয়ার ১৯ দফার চেতনা ও বর্তমান প্রজন্মের প্রত্যাশাকে সমন্বিত করতে পারে, তবে সুশাসন, ন্যায় ও সমতাভিত্তিক সমাজের রূপকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। বিএনপির ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে জনগণ তাই আশা করছে। 

স্বাধীনতার অর্ধশতকেরও বেশি সময় অতিক্রম করে বাংলাদেশ আবারও এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, গণতান্ত্রিক অনিশ্চয়তা ও রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক সংকট, সবকিছু মিলে দেশ নতুন পথ খোঁজার চেষ্টা করছে। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) তাদের ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করছে এক ভিন্ন আবহে।

চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলীয় কর্মী-সমর্থকদের প্রতি শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার অনুরোধ জানিয়েছেন। শুধু ক্ষমতার পালাবদল নয়, বরং রাষ্ট্র ও রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনই বিএনপির মূল লক্ষ্য হিসেবে তারা উচ্চারণ করেছেন। গণঅভ্যুত্থানের চেতনায় একটি জবাবদিহিমূলক গণতন্ত্র গড়ার অঙ্গীকার জনগণের মনে নতুন করে প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছে।

সম্প্রতি তারেক রহমানের বক্তব্যে যে স্পষ্টতা ও দৃঢ়তা লক্ষ্য করা গেছে, তা বিএনপির ভবিষ্যৎ রূপরেখার প্রতি আস্থা জাগিয়েছে। বিশেষত সংগঠনকে পুনর্গঠন, আন্দোলনকে নতুন ধারায় এগিয়ে নেওয়া এবং অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষায় তার কঠোর পদক্ষেপ প্রমাণ করেছে যে বিএনপি এখন আর কেবল প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির আশ্রয়ে নেই। বরং তারা একটি দূরদর্শী, প্রণোদিত রাজনীতির কৌশল অবলম্বন করতে চাইছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি এখন সর্বজনীন। জনগণ চায় জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা, মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও সমান সুযোগের নিশ্চয়তা। এই সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎকে ধারণ ও বাস্তবায়নের জন্য বিএনপিকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মাঝে আস্থা ফিরিয়ে আনা, জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া এবং ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতা দেখানো, এ সবই তাদের জন্য পরীক্ষার জায়গা হবে।

আজকের বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো- জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করা। বিএনপি যদি সত্যিই শান্তি, গণতন্ত্র ও পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতিতে অবিচল থাকতে পারে, তবে আগামী দিনের রাজনীতিতে তারা হবে নতুন দিগন্ত উন্মোচনের শক্তি। তারেক রহমানের বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্ব ও দলের দৃঢ় অবস্থান সেই পরিবর্তনের সম্ভাবনাকেই বাস্তবের পথে নিয়ে যেতে পারে।

অরণ্য পাশা, লেখক: সাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী