স্বাস্থ্য মানুষের মৌলিক অধিকার। রাষ্ট্রীয় সংবিধানে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার বারবার উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা আজ ভয়াবহ সংকটের অতলে নিমজ্জিত। হাসপাতাল মানে যেখানে একজন রোগীর আশ্রয়স্থল হওয়ার কথা, সেখানে এখন মানুষের মনে তৈরি হয়েছে এক ধরনের আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা ও অবিশ্বাস। চিকিৎসা পাওয়া যেন এক রণক্ষেত্রের যুদ্ধ আর দরিদ্র মানুষের জন্য তো তা প্রায় দুঃস্বপ্নস্বরূপ।
আমি আজ কলম ধরেছি কেবল একজন লেখক বা কলামিস্ট হিসেবে নয়, বরং একজন অসহায় ভাই হিসেবে। আমার আপন ছোট বোন বর্তমানে বগুড়ার মুহাম্মদ আলী হাসপাতালে শয্যাশায়ী। চারদিন হলো সেখানে কাতরাচ্ছে পেটের পাথরের নির্মম যন্ত্রণায়। আমাদের পরিবারের আর্থিক সামর্থ্য সীমিত। বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো সম্ভব ছিল না, তাই বাধ্য হয়েই সরকারি হাসপাতালে আশ্রয় নিতে হয়েছে। কিন্তু সেখানে গিয়ে আমরা যা দেখলাম, তা শুধু আমার বোনের দুর্ভাগ্য নয়, বরং বাংলাদেশের লাখো দরিদ্র মানুষের প্রতিদিনকার করুণ বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি।
ব্যক্তিগত বেদনা থেকে সমষ্টিগত সত্য: মুহাম্মদ আলী হাসপাতালে ভর্তি করার পরপরই আমরা বুঝতে পারলাম সরকারি হাসপাতালের অবকাঠামো আছে, ভবন আছে, কাগজে-কলমে মেশিনও আছে; কিন্তু কার্যকর সেবা নেই। ডাক্তাররা সামান্য কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা দিলেও প্রয়োজনীয় টেস্ট করার জন্য আমাদের বাইরে পাঠিয়ে দিলেন। হাসপাতালের আল্ট্রাসনোগ্রাফি, এক্সরে, এমনকি মৌলিক পরীক্ষার যন্ত্রগুলো পর্যন্ত অচল। অথচ এগুলো সচল থাকলে আমার বোনসহ অসংখ্য রোগীকে বাইরে বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হতো না। আমরা গরিব মানুষ। প্রতিটি টেস্টের অর্থ জোগাড় করা আমাদের জন্য এক অমানবিক চাপ। অথচ ডাক্তারদের নির্দেশ অমান্য করার সাহস আমাদের নেই। কারণ তাদের কথাই চূড়ান্ত। টেস্টগুলো করতে গিয়ে পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভেঙে পড়ছে, কর্মজীবী পরিবারের সদস্যরা স্বাভাবিক কাজকর্ম ফেলে হাসপাতালে দৌড়াচ্ছেন।
অপরেশন করার প্রস্তুতি চলছে, অথচ চারদিন ধরে টেস্টের ঝক্কি শেষ হচ্ছে না। এ যেন চিকিৎসা নয়, বরং আমলাতান্ত্রিক হয়রানির এক বিভীষিকাময় অধ্যায়। একজন দরিদ্র বাবা-মা, ভাই-বোনই জানেন অর্থের অভাবে চিকিৎসা করতে না পারা কতটা কষ্টের। আমাদের মতো দরিদ্র মানুষদের ব্যবহার করেই, হাসপাতাল হয় অথচ আমরাই সেবা থেকে বঞ্চিত। পরিচিত কেউ হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও চিকিৎসা ক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি হয়। আমি অসহায় হয়ে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করি প্রভু, কাউকে যেন এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে না হয়।
স্বাস্থ্যসেবার বাণিজ্যিকীকরণের অন্ধকার: বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা আজ এক সুসংগঠিত বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে টেস্ট, এক্সরে, সিটি-স্ক্যান, আল্ট্রাসনোগ্রাফি ও এমআরআইকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক চক্র। ডাক্তারদের একাংশ নির্দিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে আঁতাত করে রোগীদের সেখানে পাঠান। বিনিময়ে তারা পান মোটা অঙ্কের কমিশন। ফলে রোগীদের ওপর অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষার বোঝা চাপানো হয়। চিকিৎসা ব্যয়ের পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। রোগ নির্ণয়ের বৈজ্ঞানিক প্রয়োজনের চেয়ে ব্যবসায়িক স্বার্থ মুখ্য হয়ে ওঠে। আমার বোনের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ডাক্তারদের পরামর্শে বাইরে গিয়ে টেস্ট করাতে গিয়ে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে এটা কি সত্যিই চিকিৎসার প্রয়োজনে, নাকি এর পেছনে আর্থিক স্বার্থের লুকোচুরি আছে? এই প্রশ্ন কেবল আমার নয়; প্রতিটি রোগীর মনে একই সংশয় জন্ম নেয়।
সরকারি হাসপাতালের অচল যন্ত্রপাতি, রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি: প্রতিবছর বাজেটে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে সরকারি হাসপাতালে আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনা হয়। কিন্তু মাঠপর্যায়ে গিয়ে দেখা যায়, সেই যন্ত্রগুলো হয় অচল, নয়তো অব্যবহৃত।
কেন এমনটা হয়? রক্ষণাবেক্ষণের অভাব : মেশিন সচল রাখতে যে দক্ষ টেকনিশিয়ান প্রয়োজন, তাদের নিয়োগ দেওয়া হয় না।
দুর্নীতি: যন্ত্র মেরামতের নামে টাকা খরচ হয়, কিন্তু কাজ হয় না।
ইচ্ছাকৃত অব্যবহার: কখনো মেশিন সচল থাকলেও ব্যবহার করা হয় না, যাতে রোগীকে বাইরে পাঠিয়ে কমিশনভিত্তিক ব্যবসা চালানো যায়। মুহাম্মদ আলী হাসপাতালের বাস্তবতাই প্রমাণ করে এটি নিছক অব্যবস্থা নয়, বরং সুপরিকল্পিত দুর্নীতির অংশ। রাষ্ট্রের অর্থে কেনা যন্ত্র অচল, মেরামত না করে রোগীকে বাইরে পাঠানো মানে জনগণের করের টাকাকে ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়া।
রাজনীতি, ভোট আর জনগণের স্বাস্থ্য: বাংলাদেশের রাজনীতির আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হলো ভোট। নির্বাচন ঘিরে রাজনীতিকদের প্রতিশ্রুতির ঝড় বয়ে যায়। কিন্তু ভোট শেষ হলে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা আর তাদের অগ্রাধিকার থাকে না। রাজনৈতিক নেতাদের চিকিৎসার গল্প একেবারেই ভিন্ন। সামান্য অসুস্থ হলেই তারা বিদেশে ছুটে যান সিঙ্গাপুর, ভারত, লন্ডন কিংবা আমেরিকা। লাখ লাখ টাকা খরচ করতে তাদের কোনো দ্বিধা নেই। অথচ সাধারণ মানুষ সরকারি হাসপাতালের করিডরে অবহেলা আর অচল মেশিনের যন্ত্রণা ভোগ করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এটি কেবল স্বাস্থ্য বৈষম্য নয়; এটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্বহীনতা ও রাজনৈতিক উদাসীনতার নগ্ন প্রতিফলন।
সামাজিক অভিঘাত এই দুরবস্থা সমাজে ভয়াবহ অভিঘাত ফেলছে, অর্থনৈতিক ধ্বংস: অপ্রয়োজনীয় টেস্ট ও চিকিৎসার খরচ দরিদ্র পরিবারকে ঋণের জালে আবদ্ধ করছে।
আস্থার সংকট: ডাক্তারদের প্রতি মানুষের আস্থা কমছে। চিকিৎসা পেশা, যা একসময় মানবসেবার মহৎ প্রতীক ছিল, এখন নিছক বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। স্বাস্থ্য বৈষম্য: ধনী মানুষ বিদেশে উন্নত চিকিৎসা নিচ্ছে, গরিব মানুষ অবহেলায় মৃত্যুবরণ করছে।
দালাল চক্রের আধিপত্য: সরকারি হাসপাতালে দালাল চক্র সক্রিয়, যারা রোগীকে বাইরে পাঠাতে চাপ দেয়, বেশি দামে টেস্ট করায় এবং কমিশন ভাগাভাগি করে। আমার বোনের অভিজ্ঞতা এই প্রতিটি বাস্তবতাকে নির্মমভাবে সামনে নিয়ে এসেছে।
করণীয়: এই অব্যবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য জরুরি পদক্ষেপ হলো যন্ত্রপাতি সচল রাখা। সরকারি হাসপাতালে কেনা প্রতিটি মেশিন দ্রুত মেরামত করে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।
কমিশন সংস্কৃতি বন্ধ: ডাক্তার ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের আঁতাত আইনের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করতে হবে। গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা শক্তিশালী করা: উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে আধুনিক হাসপাতাল ও দক্ষ জনবল নিশ্চিত করতে হবে।
রাজনৈতিক সদিচ্ছা : নেতাদের বিদেশমুখী চিকিৎসা প্রবণতা সীমিত করে দেশে স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে বিনিয়োগ করতে হবে।
জনগণের জবাবদিহি: প্রতিটি হাসপাতালের কার্যক্রম জনগণের সামনে উন্মুক্ত করতে হবে, যাতে জানা যায় কোন যন্ত্র কোথায় ব্যবহৃত হচ্ছে।
আমার বোনের যন্ত্রণা নিছক ব্যক্তিগত নয়, এটি জাতীয় সংকটের প্রতীক। তিনি কেবল একজন রোগী নন; তিনি বাংলাদেশের লাখো দরিদ্র মানুষের প্রতিনিধি যারা প্রতিদিন সরকারি হাসপাতালের অব্যবস্থা, ডাক্তার-ডায়াগনস্টিক আঁতাত আর রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার শিকার হচ্ছেন। যদি রাষ্ট্র এখনই এই ব্যর্থতা কাটিয়ে না ওঠে, তবে আগামী প্রজন্মের জন্য স্বাস্থ্যসেবা আরও ভয়াবহ রূপ নেবে। ভোটের রাজনীতি যতই গুরুত্বপূর্ণ মনে হোক না কেন, একটি জাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে জনগণের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতেই হবে। কারণ, অসুস্থ জাতি কখনো উন্নত জাতি হতে পারে না। আজকের প্রার্থনা একটাই আমার বোনের মতো আর কোনো দরিদ্র রোগী যেন হাসপাতালের করিডরে বঞ্চনার শিকার হয়ে জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে না হয়। রাষ্ট্র যেন জাগে, প্রশাসন যেন জবাবদিহি করে, আর স্বাস্থ্যসেবা ফিরে পাক তার মানবিক মর্যাদা।