ঢাকা শনিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৫

মতামত

সামরিক বাহিনীর সিদ্ধান্তে গুজববাজদের মাথায় বাজ

এম. আব্দুল্লাহ আল মামুন খান
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৭, ২০২৫, ১১:৪১ পিএম
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। ছবি- সংগৃহীত

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ঘিরে গত এক বছর যাবতই গুজবের নামে গজবের এক পরিবেশ বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। সেনাবাহিনী ক্ষমতা নিচ্ছে, দেশে জরুরি অবস্থা জারি হচ্ছে ইত্যাকার মিথ্যা-বিষে পূর্ণ মানুষের কান। অন্তর্বর্তী সরকার আর সেনাবাহিনীকে মুখোমুখি দাঁড় করাতে সব ঘটনা-রটনা ছড়ানো হচ্ছে দিনের পর দিন। আম পাবলিক যেন গুজব গিলে এজন্য মুখরোচক ফ্যাক্ট হিসেবে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সেনাপ্রধানের কাল্পনিক দ্বন্দ্ব তৈরি করে তুমুল জোশে বিপুল বিক্রমে কেউ কেউ রাজা-উজিরও মারছেন। দিন গড়াতেই বেহুঁশ থেকে হুঁশে ফিরছেন নেটিজেনরা। গুজববাজরা কুপোকাত হলেও থেমে নেই। বিদ্যুৎ গতিতে ভুয়া তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণী রঙ মিশিয়ে ভাইরাল করছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে গুমসংক্রান্ত ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের’ মামলায় কর্মরত ১৫ সেনাকর্মকর্তাসহ মোট ২৫ জন সাবেক ও বর্তমান সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির ঘটনায় গুজবসেবীদের যেন কেল্লাফতে অবস্থা! 

সেনাবাহিনীর হাইকমাণ্ড বিশেষ করে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এসব সেনা কর্মকর্তাদের রক্ষায় মরিয়া এখন গুজববটিকা ছড়ানো হচ্ছিল গেল কয়েকদিন। কিন্তু সেনা সদর দপ্তর যখন আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়ে দিলো সংবিধান স্বীকৃত আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সেনাবাহিনী চার্জশিটভুক্ত ১৫ কর্মকর্তাকে সেনা হেফাজতে নিয়ে এসেছে, তাদেরকে পরিবার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছে তখনই প্রথম ধাক্কা খেলো গুজববাজরা। শেক্সপিয়ারের ‘হেনরি দ্য ফোর্থ’ নাটকের আলোচিত ‘গুজব’ চরিত্রে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে কতিপয় ভণ্ড ও জ্ঞানপাপী সোশ্যাল মিডিয়ার ভিলেনরা কার্যত ফেঁসে গেলেন। গত সোমবার ঢাকা সেনানিবাসের একটি ভবনকে সাময়িকভাবে কারাগার ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। এবার ধুরন্ধর চক্রটি যেন ব্যস্ত-সমস্ত বিচারের আগেই ওইসব সেনা কর্মকর্তাদের আগাম শাস্তির বন্দোবস্তে! গুটিকয়েক সেনা কর্মকর্তার জন্য গোটা সেনাবাহিনীকে কলঙ্ক কালিমা লেপনের হাতিয়ার হিসেবে অযাচিত সোশ্যাল মিডিয়া ট্রায়াল! পক্ষ-বিপক্ষ প্রচারণায় সয়লাব সামাজিক মাধ্যম। 

সামগ্রিক ঘটনাপ্রবাহের বিষয়ে সেনাবাহিনীর অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল (এজি) মেজর জেনারেল মো.হাকিমুজ্জামান গত শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, কেউ চার্জশিটভুক্ত আসামি হলেই সে অপরাধী হিসেবে প্রমাণিত নয়। ওই সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, আইনি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সেনা কর্মকর্তাদের হেফাজতে রাখা হয়েছে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সেনা সদস্যদের বিচার ও তাদের হেফাজতে নেওয়ার বিষয়ে নানা আলোচনার মধ্যে এক্স-ফোর্সেস অ্যাসোসিয়েশনও এ বিষয়ে নিজেদের মতামত তুলে ধরেছে। মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট সাইফুল্লাহ খাঁন সাইফ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় যে সেনা কর্মকর্তাদের নাম এসেছে, তাদের বিচার সেনা আইনেই বিচারের দাবি জানিয়েছেন। সেনাবাহিনীর সাবেকদের এই সংগঠন বলছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) আইনে বিচার হলে ভবিষ্যতে অপরাধীরা ‘পার পেয়ে যেতে পারে’। ‘প্রয়োজনে’ সেনা আইন সংশোধন করে তার আওতায় জড়িতদের বিচার করা হোক।’

চার্জশিটভুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের সেনা হেফাজতে নিয়ে আসার স্মার্ট সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা নসাৎ করে দিয়েছেন। দেশের প্রধান দু’রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াত সেনাবাহিনীর এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। গত শনিবার রাতে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বিষয়টি নিয়ে দলের অবস্থান তুলে ধরা হয়। বলা হয়, ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি বিশ্বাস করে, দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সেনাবাহিনীর পেশাদারি রক্ষায় সংশ্লিষ্ট অপরাধের সুষ্ঠু ও নির্মোহ বিচার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিছু চিহ্নিত ব্যক্তির দায় যেমন কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপানো উচিত নয়, তেমনি তাঁদের অপকর্মের কারণে সেই প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্নবিদ্ধ করাও অনুচিত। একজন মানুষের কাজের ভালো-মন্দের দায়, বিশেষত গুরুতর অপরাধের শাস্তি একান্তই তার নিজের।’

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে নিয়ে বাংলাদেশের জনগণ গর্বিত থাকতে চান। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাহিনীর কিছু সদস্য দেশের বিদ্যমান আইন ও মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়েছেন। ফ্যাসিস্ট সরকারের প্ররোচনায় প্রতিপক্ষ নিধনের এজেন্ডা বাস্তবায়নে তারা অন্ধ সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন। ফলে গুম ও খুনের একটি ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। তবে সুনির্দিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তির অপরাধের কারণে পুরো প্রতিষ্ঠানকে কলঙ্কিত হতে দেওয়া যায় না। অপরাধের দায় কেবল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ওপরই বর্তাবে। এরই মধ্যে সেনাবাহিনী এই বিচারপ্রক্রিয়াকে সহায়তা করার ঘোষণা দিয়েছে এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের হেফাজতে নিয়েছে। আমরা সেনাবাহিনীর এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।’

রাজনৈতিক ও সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সেনাবাহিনী একটি বিশাল প্রতিষ্ঠান। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার অতন্দ্রপ্রহরী। দেশের প্রতিটি দুর্যোগে-সঙ্কটে সেনাবাহিনীর ভূমিকা ঐতিহাসিক। গত বছরের ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার রক্তস্নাত গণঅভ্যুত্থান চূড়ান্ত সফলতা পেয়েছে সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমী সিদ্ধান্তের দৌলতেই। বিশাল এই বাহিনীর গুটিকয়েক কর্মকর্তার অপরাধের দায় কখনও বাহিনীর নয়। অস্বীকার করার উপায় নেই অভিযুক্ত এসব সেনা কর্মকর্তারা ফ্যাসিস্ট রেজিমের নীতি নির্ধারকদের ‘অবৈধ হুকুম’ বাস্তবায়ন করেছেন। সেটি লোভের বশবর্তী বা রাজনৈতিক চাপ যেভাবেই হোক না কেন? তবে আশার কথা হচ্ছে- সেনা নেতৃত্ব তাদের ব্যাপারে ন্যূনতম ছাড় দেয়নি। 

সেনাবাহিনীর অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল (এজি) মেজর জেনারেল মো.হাকিমুজ্জামানও বলেই দিয়েছেন, ‘সংবিধান স্বীকৃত বাংলাদেশের সব আইনের প্রতি সেনাবাহিনী শ্রদ্ধাশীল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ও সেনা আইন মুখোমুখি নয়। একটা বনাম আরেকটা এই দৃষ্টিভঙ্গিতে এটা দেখা উচিত হবে না। সেনাবাহিনী দ্ব্যর্থহীনভাবে বিচারের পক্ষে অবস্থান করে। সেনাবাহিনী ন্যায়বিচারের পক্ষে। আমরা বিশ্বাস করি, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। গুমের শিকার পরিবারগুলোর প্রতি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছে।’ তিনি সেনাপ্রধানকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, ‘আমরা জাস্টিসের পক্ষে, নো কম্প্রোমাইজ উইথ ইনসাফ।’ 

অবসরপ্রাপ্ত বেশ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা বলেন, অভিযুক্তরা ঘটনার সময় কেউ সেনাবাহিনীতেই কর্মরত ছিলেন না। র‌্যাব, ডিজিএফআই—এসব সংস্থায় পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে কেউ অপরাধ করে থাকলে আইন অনুযায়ী অবশ্যই তার বিচার হবে। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে তার শাস্তি হবে। সামরিক আইনেই যে কোনো ধরনের অপরাধের বিচারের সুযোগ রয়েছে এবং সে কারণেই তারা কেউ কেউ মনে করেন বিষয়টি যেভাবে জনসম্মুখে আনা হয়েছে তা সামরিক বাহিনী মর্যাদা ও সম্মানের সঙ্গে যায়নি। শুধু তাই নয়, যেভাবে সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে বিচারের আগেই শাস্তির ঘটনার একটি ট্রায়াল রান দেখা যাচ্ছে। এই অপতৎপরতা বন্ধ করতে হবে। বিচারের নামে যাতে কোন প্রহসন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, সেনাবাহিনী এদেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। কোন অযাচিত পদক্ষেপ দেশের সার্বভৌমত্বকে যেন দুর্বল না করে, দেশের নিরাপত্তা যেন অরক্ষিত না হয়। 

জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘সেনাবাহিনীর কেউ কোনো অপরাধ করলে এবং সেটি তদন্ত আদালতে প্রমাণিত হলে তার বিচারের সুযোগ বাহিনীতে আছে। বিষয়টি এভাবে জনসম্মুখে আসার আগে এ বিষয়ক সব বিষয় পরিষ্কার হওয়া উচিত ছিলো। সেনাবাহিনীর সম্মান ও মর্যাদার বিষয়ে সবার সতর্ক থাকা দরকার।’ 

লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক সন্ধানী বার্তা এবং অ্যাকটিং এডিটর, কালের আলো.কম।