ঢাকা শুক্রবার, ১০ অক্টোবর, ২০২৫

মতামত

আমাদের সংবিধান স্বৈরতন্ত্র তৈরির কারখানা!

লুৎফর রহমান হিমেল
প্রকাশিত: অক্টোবর ১০, ২০২৫, ০৩:৪২ পিএম
লুৎফর রহমান হিমেল।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা আমাদের সামনে বারবারই এক গভীর সংকটে ফেলে দেয়। এই সংকটের মূলে আসলে গণতন্ত্রের নিজেরই সংকট। আর গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে খোদ সংবিধানই। অথচ সংবিধান এবং গণতন্ত্র অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, সংবিধান গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করে এবং এর কার্যকারিতা নিশ্চিত করে। কিন্তু সেই সংবিধান যদি গণতন্ত্রকেই হত্যা করে তখন আর আমাদের সামনে এগুবার পথ থাকে না। যার জন্য সংবিধান সংস্কার, এমনকি বদলে ফেলার দরকার অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে। কিন্তু কিছু মহল এর ঘোরবিরোধী। তাদের কাছে সংবিধান হল ধর্মগ্রন্থের মতো!

এমতাবস্থায় প্রশ্ন উঠে—সংবিধান বড়, নাকি গণতন্ত্র বড়?

প্রায় সতেরো বছর শেখ হাসিনা ক্ষমতায় টিকে ছিলেন মূলত সংবিধানের দোহাই দিয়ে। কিন্তু সেই সময়ে কার্যকর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুপস্থিত ছিল। নির্বাচনগুলো ছিল প্রতিযোগিতাহীন, বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির অংশগ্রহণ ছিল সীমিত, আর জনগণের প্রকৃত মতামত প্রকাশের কোনো পথ খোলা ছিল না। ভোটারবিহীন এসব নির্বাচনে সংবিধান ছিল, কিন্তু গণতন্ত্র ছিল না। মানে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় নির্বাচন জরুরি ছিল, কিন্তু তাতে ভোটারের দরকার ছিল না।

সংবিধান আসলে কেবল একটি দলিল—এটি জনগণের জন্য, জনগণের হাতে তৈরি। কিন্তু যখন সংবিধানের ধারা বা ব্যাখ্যা ব্যবহার হয় শুধু ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার অস্ত্র হিসেবে, তখন সেটি তার মূল উদ্দেশ্য হারায়। গণতন্ত্র তখন রুদ্ধ হয়ে যায়, জনগণের অধিকার ও অংশগ্রহণ অবরুদ্ধ হয়।

এই অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে—সংবিধান নয়, গণতন্ত্রই বড়। কারণ গণতন্ত্রই জনগণের কণ্ঠস্বর, জনগণের অধিকার, জনগণের অংশগ্রহণ। সংবিধান সেই গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দেওয়ার মাধ্যম মাত্র। কিন্তু গণতন্ত্র যদি না থাকে, সংবিধানও তখন কেবল কাগজের একখণ্ড দলিল ছাড়া আর কিছু নয়।

তাহলে সমস্যার মূলে কী? সমস্যা হলো—আমাদের সংবিধান কাঠামোগতভাবে স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র তৈরি করে। এটি স্বৈরতন্ত্র এবং একনায়কতন্ত্র তৈরির ফ্যাক্টরি।

গণতন্ত্র মানে জনগণের তন্ত্র, আর একনায়কতন্ত্র মানে একজনের তন্ত্র। অথচ বাংলাদেশে ক্ষমতার বাস্তব কাঠামো এমনভাবে সাজানো যে, একজন নেতার হাতে সংসদ ও সরকারের সব ক্ষমতা এসে জমা হয়।

উদাহরণস্বরূপ, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ। এই অনুচ্ছেদ অনুসারে, সরকারদলীয় কোনো সাংসদ যদি দলনেতার নির্দেশ অমান্য করেন, তবে তিনি সাংসদ পদ হারাবেন। ফলে সংসদে জনগণের প্রতিনিধি আসলে স্বাধীনভাবে কথা বলার সুযোগ পান না। সরকারপ্রধান যা চান, সংসদে সেটাই পাস হয়। সংসদ তখন জনগণের নয়, একজনের ইচ্ছার প্রতিফলন হয়ে ওঠে।

এই বাস্তবতা প্রমাণ করে—আমাদের সংবিধান জনগণের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার বদলে এক ব্যক্তির ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।

তাই বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য দরকার জনগণের সত্যিকারের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া। সংবিধানকে হতে হবে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন, ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার যন্ত্র নয়।

অতএব অন্যান্য সংস্কারের পাশাপাশি সবার আগে দরকার সংবিধান সংস্কার। কারণ সংবিধান যদি গণতন্ত্রকে হত্যা করে, তবে সেটি আর জনগণের নয়—ক্ষমতার দখলদারদের দলিল মাত্র।

কলামিস্ট, সাংবাদিক