ঢাকা বুধবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ কেন জরুরি

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১০, ২০২৫, ০১:২২ এএম

গণতন্ত্রের পথে অনেক অন্তরায়, যে জন্য তার পক্ষে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সম্ভব হয় না। বলা যাবে এবং অবশ্যই বলা হয়ে থাকে যে, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে না উঠলে গণতন্ত্র পাওয়া যাবে না। বলতে পারব এমন কথাও যে, গণতন্ত্রের একেবারে প্রাথমিক শর্তই হলো পরমতসহিষ্ণুতা ও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। কিন্তু হঠাৎ করে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন যে প্রধান প্রতিবন্ধকতাটা কি? তাহলে বিচলিত বোধ না করে এক কথাতেই তার জবাব দেওয়া সম্ভব। প্রধান অন্তরায় অন্যকিছু নয়, রাষ্ট্র। রাষ্ট্র এবং গণতন্ত্রকে একত্র করার চেষ্টা চলে। কেননা গণতন্ত্র তো আকাশে ফলে না, তাকে থাকতে ও বাড়তে হয় রাষ্ট্রের ভেতরে থেকেই; কিন্তু তারা একসঙ্গে যায় না, রাষ্ট্র ও গণতন্ত্র পরস্পরের মিত্র নয়, প্রতিপক্ষ বটে। যে জন্য যথার্থ গণতন্ত্রের স্বপ্ন যারা দেখেন তারা রাষ্ট্রহীন সমাজের কল্পনা করতে ভালোবাসেন। ওদিকে গণতন্ত্রের জন্য যারা সংগ্রাম করেন দৃশ্যমান হওয়া মাত্রই তাদের রাষ্ট্রদ্রোহী বলে চিহ্নিত করা হয়, আর রাষ্ট্রের চোখে রাষ্ট্রদ্রোহিতার চেয়ে ভয়ঙ্কর অপরাধ তো দ্বিতীয়টি নেই। 

কিন্তু রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের এই যে পরস্পরিক বৈরী অবস্থান, এর কারণটা কি? কারণ হলো এই যে, রাষ্ট্র দেখে কতিপয়ের স্বার্থ, আর গণতন্ত্র দেখতে চায় সবার স্বার্থ।  বিরোধটা ওখানেই; কতিপয়ের সঙ্গে সর্বসাধারণের। রাষ্ট্রের অভ্যুদয় চুক্তির ভেতর দিয়ে ঘটেছে, এমনটা অনেকে ধারণা করে থাকেন। কিন্তু কার সঙ্গে কার চুক্তি? জনগণের সঙ্গে শাসকদের? সেটা অন্য সময়ে ঘটে না। ঘটে তখন, যখন শাসকদের কাছ থেকে জনগণ চাপ দিয়ে কিছু অধিকারের প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেয়।

সবকিছুই ব্যবহৃত হয় শাসকের স্বার্থে। দুপক্ষের ভেতর এই যে বৈষম্য রাষ্ট্র এর ওপরই দাঁড়িয়ে থাকে, শাসকের হয়ে সে কাজ করে শাসিতের বিরুদ্ধে। দুয়ের ভেতরে যে অমীমাংসের দ্বন্দ্ব, রাষ্ট্রের আবশ্যকতাটা দেখা যায় সেখানেই। যথার্থ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে এই বৈষম্য থাকবে না, তখন রাষ্ট্র অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে, হয়তো-বা উবেই যাবে। এ কোনো কষ্টকল্পনার নৈরাজ্যিক কল্পকাহিনি নয়, একটা যৌক্তিক স্বপ্ন বটে, মানুষের মুক্তির স্বপ্ন। 

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনেও একটা অলিখিত চুক্তি ছিল। সেটি সমগ্র জনগণের, মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশ নিয়েছিলেন তাদের সবার, এমনকি সরাসরি যারা অংশ নিতে পারেননি তাদেরও। ১৯৭২-এর সংবিধান ওই চুক্তিরই ফল; যে জন্য এতে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার স্বপ্ন লিপিবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু সেই স্বপ্ন তো অক্ষত থাকেনি। গণতন্ত্র কোথায় পাব? আমরা তো কখনো নির্বাচিত, কখনো-বা অনির্বাচিত শাসকদের দ্বারা অগণতন্ত্রাতিকভাবেই শাসিত হয়ে যাচ্ছি। সামরিক শাসকেরা এসে আদি সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করে ছেড়েছে; এমনকি রাষ্ট্রের যিনি প্রতিষ্ঠাতা ও জনগণের অবিসংবাদিত নেতা তিনিও ওই সংবিধানকে বদলে দিয়ে তার মাধ্যমেই একদলীয় শাসন কায়েমের ব্যবস্থা করেছিলেন; যে কাজটি ছিল রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তা হিসেবে জনগণের কাছ থেকে তার বিচ্ছিন্নতার হৃদয়বিদারক এক স্মারকচিহ্ন এবং তার সেই বিচ্ছিন্নতাকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে ১৫ আগস্টে তার ওপর অবিশ্বাস্য রকমের নির্মম এক আঘাত করার মতো দুঃসাহস সংগ্রহ করতে পেরেছিল।

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকামী শেখ মুজিব পাকিস্তানি রাষ্ট্রের কর্ণধারদের কাছে ‘ঘৃণ্য’ রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে অভিহিত হয়েছিলেন, আর গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি নিয়ে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশি রাষ্ট্রের কর্তা হয়ে তিনিই বুর্জোয়া গণতন্ত্রের অপরিহার্য স্তম্ভ বহুদলীয় ব্যবস্থাকে নিজ হাতে নষ্ট করে দিয়ে তার নিজের দলকে একমাত্র দল হিসেবে দাঁড় করানোর উদ্যোগ নিলেন। শেখ মুজিবের নতুন বিবেচনায় বিরোধী দল তখন রাষ্ট্রদ্রোহীতে পরিণত হয়েছিল বৈকি। রাষ্ট্র তার নিজের প্রয়োজনে, অর্থাৎ সমষ্টির বিরুদ্ধে কতিপয়ের স্বার্থকে পুষ্ট ও কায়েমি করার অভিপ্রায়ে, গণতন্ত্রের ওপর হস্তক্ষেপ করতে কুণ্ঠা প্রকাশ করেনি। এরপর ক্রমপরিবর্তনের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রও ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের মতোই অগণতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে।

গণতন্ত্র বলতে কি বুঝি সেটা ঠিক করে নেওয়া ভালো। গণতন্ত্র অর্থ কেবল যে ভোট নয় সেটা তো আমরা সবাই জানি। ভোটে কারচুপি, কেনাবেচা, জালিয়াতি, এটা কোন রাষ্ট্রে না হয়; কিন্তু তবু ভোট গণতন্ত্রের অপরিহার্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল বৈকি। ভোটকে আমরা দেখতে চাইব রাষ্ট্রের ওপর জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্য পন্থা হিসেবে। গণতন্ত্রের প্রাথমিক সংজ্ঞাটি ওইখানেই নিহিত রয়েছে। গণতন্ত্র হচ্ছে সেই ধরনের রাষ্ট্র যা জনগণের স্বার্থ দেখে, তাদের নিরাপত্তা দেয় এবং তাদের পক্ষে কাজ করে। রাষ্ট্র যদি এই কাজ করতে চায় তবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। ক্ষমতা এক জায়গায়, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে জড়ো হয়ে থাকবে না, ছড়িয়ে যাবে পরিধিতে; এবং সর্বস্তরেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, এটাই হলো গণতন্ত্রসম্মত ধারা। 

সবচেয়ে বড় কথা, রাষ্ট্রের নাগরিকদের ভেতর বৈষম্য থাকবে না, থাকবে অধিকার ও সুযোগের সাম্য। গণতন্ত্রের এই সংজ্ঞা যদি গ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে বুঝতে বিলম্ব হবে না যে, রাষ্ট্র কেন গণতন্ত্রবিরোধী। গণতন্ত্রের অরেক গুণ। তাদের মধ্যে প্রথম ও প্রধান হচ্ছে এটি যে, গণতন্ত্র সব মানুষের উন্নতি চায়। ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যে সে বিশ্বাস করে, সেই স্বাতন্ত্র্যকে মর্যাদা দেয় এবং ব্যক্তির মুক্তির জন্যই সমষ্টির মুক্তি চায়, কেননা গণতন্ত্র জানে যে ব্যক্তির মুক্তি নিহিত রয়েছে সমষ্টির মুক্তিতে। তবে ব্যক্তিকে নিয়ে শুরু করে লাভ হবে না, শুরু করা চাই সমষ্টিকে নিয়েই।

গণতন্ত্র বৈচিত্র্যে বিশ্বাস করে এবং বৈচিত্র্যকে রক্ষা করে চলে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষের সঙ্গে মানুষের বিচ্ছিন্নতা কমে আসে, রাষ্ট্রের ওপর নাগরিকদের আস্থা বাড়ে এবং রাষ্ট্র তার স্বৈরাচারী চরিত্র পরিত্যাগ করে জনগণের জন্য সহায়ক হয়ে উঠতে চায়। গণতন্ত্রের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো জবাবদিহিতার দায়। সরকারকে সমালোচনা করা চলে, করতে গেলে গর্দানটা চলে যাবে, এমন ভয় থাকে না। সরকার সমালোচনা শোনে, শুনে নিজেকে সংশোধন করে নেয়। অন্য ব্যবস্থায় যেটা মোটেও আশা করা যায় না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যে নিখুঁত তা বলা যাবে না, তবে যতগুলো ব্যবস্থার সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে, অভিজ্ঞতা রয়েছে বসবাসের, তাদের ভেতর এটাই যে সর্বশ্রেষ্ঠ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। 

রাষ্ট্র ও সরকার এক নয়। রাষ্ট্র সহজে বদলায় না, কিন্তু সরকার বদলানো অসম্ভব নয়। সরকার বদলালে রাষ্ট্র যে বদলে যায় তা নয়। রাষ্ট্র আগের মতোই থাকে, সরকার তার ইচ্ছামতো ছোটখাটো সংশোধন আনে মাত্র। রাষ্ট্র ও সরকারের ভেতর এই পার্থক্যের কথাটা পাঠ্যপুস্তকে পাওয়া যায়। বাস্তবেও তা সত্য। রাষ্ট্র নয়, কোনো কোনো সরকার চায়নি বা না গণতন্ত্র আসুক; রাষ্ট্র এখানে জড়িত নয়, কেননা রাষ্ট্র হচ্ছে নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান। তা ওইরকমই মনে হয় বটে, বাইরে থেকে রাষ্ট্রকে নিরপেক্ষ বলেই ধারণা করা যায়; সে কোনো দলের পক্ষে নেই, যে আসবে তাকেই গ্রহণ করবে। কিন্তু রাষ্ট্রের তো নিরপেক্ষ থাকার কথা নয়, তার তো অবস্থান নেওয়ার কথা। তার তো থাকার কথা জনগণের পক্ষে। থাকত অবশ্যই, যদি সে গণতন্ত্রের পক্ষে হতো। 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়