রাজধানীর সরকারি সাত কলেজ নিয়ে প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি গঠন ও প্রশাসনিক কাঠামো বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে বিতর্কের আগুন জ¦ালিয়েছে। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, সাত কলেজকে চারটি অনুষদে ভাগ করে ২৩টি বিষয়ে স্নাতক পাঠদান চালানো হবে। তবে এই প্রক্রিয়ায় সব কলেজে এখনকার মতো সমগ্র বিষয়পাঠ না থাকা এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যায় সীমাবদ্ধতা শিক্ষাব্যবস্থার জন্য তৈরি করেছে নতুন চ্যালেঞ্জ। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অবস্থান এখানে দ্বন্দ্বমূলক। শিক্ষকেরা বলছেন, এই নতুন কাঠামো বাস্তবায়িত হলে সাত কলেজের শত বছরের ঐতিহ্য বিপন্ন হবে।
কলেজগুলোর স্বকীয়তা হারানো, উচ্চ শিক্ষার সুযোগ সংকুচিত হওয়া এবং শিক্ষকদের পদসংখ্যায় জটিলতা সৃষ্টি হবে। এ সবই তাদের প্রধান উদ্বেগ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ঢাকা কলেজে প্রতি বছর স্নাতক পর্যায়ে প্রায় তিন থেকে চার হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হন। নতুন নিয়মে প্রতিটি বিষয়ের জন্য ভর্তি ৪০ জনে সীমাবদ্ধ থাকলে বাকি শিক্ষার্থীরা কোথায় যাবেন? এটি একটি গুরুতর প্রশ্ন। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে। তাদের যুক্তি, ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি একটি স্বাধীন, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলে শিক্ষা সিন্ডিকেট ভেঙে নতুন সম্ভাবনার পথ খুলবে। তারা মনে করেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে সাত কলেজকে অধিভুক্ত করলে শিক্ষার্থীর স্বতন্ত্র অধিকার ও উচ্চ শিক্ষার সম্ভাবনা সীমিত হবে।
এ কারণে তারা আন্দোলন ও মানববন্ধনের মাধ্যমে অধ্যাদেশের ত্বরান্বিত জারি দাবি করছেন। তবে এই দ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছে প্রকৃত সমস্যাগুলোও। শিক্ষকেরা যে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, তা একেবারেই ভিত্তিহীন নয়। সাত কলেজের প্রতিটি কলেজই তার নিজস্ব ঐতিহ্য, ইতিহাস ও শিক্ষার মান ধরে রেখেছে। যেমনÑ ঢাকা কলেজ উপমহাদেশের প্রথম আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ইডেন মহিলা কলেজ নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রণী। এই কলেজগুলোর স্থাপত্য, অবকাঠামো, শিক্ষাদানের বৈচিত্র্য এবং উচ্চ মাধ্যমিক কার্যক্রম সবই স্বতন্ত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়িক কাঠামো চালু হলে যদি এই দিকগুলো উপেক্ষিত হয়, তা শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষার মান হ্রাস, ক্যাম্পাসের জটিলতা এবং উচ্চশিক্ষার সুযোগ সংকুচিত করার মতো সমস্যা তৈরি করতে পারে।
এ ক্ষেত্রে সাত কলেজ দ্বন্দ্বে সমাধানের পথ হতে পারে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের মতামত শুনে একটি সমন্বিত কাঠামো তৈরি করা। এতে কলেজগুলোর ঐতিহ্য ও স্বকীয়তা অক্ষুণœ থাকবে এবং শিক্ষার্থীর স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নও বাস্তবায়িত হবে। উদাহরণস্বরূপ, প্রতিটি কলেজে তাদের পরিচিত বিভাগগুলো রেখে নতুন অনুষদগুলোর অধীনে স্বতন্ত্র ক্যাম্পাসের মাধ্যমে পাঠদান চালানো যেতে পারে। ভর্তির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা হলেও পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষার্থীকে সুযোগ দেওয়া জরুরি, যাতে শিক্ষার মান ও গ্রহণযোগ্যতা না হারায়। এ ছাড়া, নারীদের ভর্তি এবং উচ্চ মাধ্যমিক কার্যক্রম অক্ষুণœ রাখা শিক্ষার সমানাধিকারের জন্য অপরিহার্য।
সাত কলেজকে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলা হলে একদিকে শিক্ষার্থীর স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত হবে, অন্যদিকে শিক্ষক ও শিক্ষার মান রক্ষিত থাকবে। তবে শিক্ষাক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা এবং সুসংগঠিত পরিকল্পনা ছাড়া এই প্রক্রিয়া বিপরীত ফলও দিতে পারে। তাই সরকারকে ইউজিসি এবং কলেজগুলোকে অংশীজনদের সঙ্গে বসে সব পক্ষের আশঙ্কা ও দাবিগুলো বিবেচনা করে সমাধান বের করতে হবে। ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটিকে এখন শুধুই নতুন একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভাবলে হবে না, এটি দেশের শিক্ষার মান, কলেজের ঐতিহ্য এবং শিক্ষার্থীর স্বপ্নের প্রতিফলন। তাই শিক্ষার্থী-শিক্ষক উভয় অংশীজনকে একসঙ্গে নিয়ে সুনিশ্চিত পরিকল্পনা গ্রহণই দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তনের পথে প্রথম ধাপ হতে পারে।