ঢাকা শনিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

চাকরি ক্ষেত্রে বৈষম্য, বিশেষায়িত শিক্ষা, অদৃশ্য সুযোগ

নাফিউ সাজিদ জয়
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৫, ০১:১৪ এএম

প্রাক্তন শিক্ষার্থী, প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আমাদের দেশে এমন অনেক বিশেষায়িত সাবজেক্ট আছে, যার শিক্ষার্থীরা চাকরি ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। সেসব বিষয়ের বহির্বিশ্বে অনেক চাহিদা থাকার পরও শিক্ষার্থীরা নিজ দেশে যথাযথ মূল্যায়ন না পাওয়ার ফলে অধিকাংশ সময়েই বিদেশগামী হচ্ছে। প্রায়শই আমরা ব্রেন ড্রেইনের বুলি আওড়াই এবং দুঃখ প্রকাশ করি, কিন্তু এতটুকুই। এ বিষয়ে পরবর্তীতে আর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করি না। মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধ্যয়ন অর্থাৎ প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন স্টাডিজ, বাংলাদেশে পড়ানো একটি অনন্য অসাধারণ ডিসিপ্লিন যা কেবলমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন সংখ্যা হিসেবে প্রত্যেক বছর এ বিভাগ থেকে ৩৫ জন স্নাতক বাংলাদেশের চাকরিবাজারে প্রবেশ করছে। ২০১৫ সালে শুরু হওয়া এই বিভাগ থেকে ইতোমধ্যেই চারটি ব্যাচ স্নাতক এবং তিনটি ব্যাচ স্নাতকোত্তর শেষ করে বেরিয়েছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চাকরিদাতারা এ বিষয়ে স্পষ্টতই কোনো ধারণা রাখেন না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ বিষয়ে বা এই নামে যে কোনো ডিসিপ্লিন আছে এবং এখানে অনেক বৈচিত্র্যপূর্ণ বিষয়ে পড়ানো হয় তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানে না। যার ফলে প্রতিনিয়তই এই বিষয় থেকে পাস করে বের হওয়া শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। 

কিন্তু হওয়ার কথা ছিল কিন্তু ভিন্ন। কারণ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই পাবলিকেশন অফিসার বা এই সংক্রান্ত যেসব পদ রয়েছে তাতে এই বিভাগের শিক্ষার্থীরাই অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। প্রায়শই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়, বিভিন্ন সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে সম্পাদক, সহ-সম্পাদক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়, কিন্তু এখানে নির্দিষ্ট করে অন্যান্য বিভাগের নাম উল্লেখ করা থাকলেও এই বিভাগের নাম উল্লেখ থাকে না। এর কারণ হয়তো বা চাকরিদাতা জানেন না প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন স্টাডিজ নামের একটি বিভাগ রয়েছে, কিংবা জানেন না যে, এই বিভাগেও বিভিন্ন সেমিস্টারে সম্পাদনা সম্পর্কিত কোর্স পড়ানো হয়। যার মধ্যে প্রথম বর্ষেই এখানে শিক্ষার্থীকে বাংলা ও ইংরেজি লেখায় দক্ষ করার জন্য বাংলা লিখনশৈলী ও ইংরেজি লিখনশৈলী সম্পর্কিত দুটি কোর্স করানো হয়। যেখানে বাংলা ও ইংরেজি ব্যাকরণ থেকে শুরু করে লেখার গঠন এবং লেখাকে মানসম্পন্ন লেখায় পরিণত করার কলাকৌশল সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের ধারণা দেওয়া হয়। পাশাপাশি কপি এডিটিং এবং প্রুফ রিডিংও শেখানো হয়।

দ্বিতীয় বর্ষে প্রফেশনাল এবং ক্রিয়েটিভ রাইটিং এর উপরে আরও অ্যাডভান্সড কোর্স করানো হয়, শেখানো হয় একাডেমিক লিখনশৈলী, একাডেমিক এবং নন-একাডেমিক লেখার সম্পাদনা কৌশল, সম্পাদনা ব্যবস্থাপনা। ঠিক এভাবেই প্রতি বর্ষে বিভিন্ন সেমিস্টারের শিক্ষার্থীদের মুদ্রণ ও প্রকাশনার মৌলিক বিষয়গুলোর পাশাপাশি, গবেষণা, লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের ইলেকট্রনিক প্রকাশনা অর্থাৎ ই-পাবলিকেশন সম্পাদনা বিষয়েও দক্ষ করে গড়ে তোলা হয়। 

সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে এ বিষয়ে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করলেও সংশ্লিষ্ট কাজের ক্ষেত্র খুব একটা পাচ্ছেন না। মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্প ছাড়াও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এমনকি স্কুলগুলোতে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায়ও এ বিভাগের শিক্ষার্থীরা আবেদনের সুযোগ পান না। যদিও বাংলা, ইংরেজি, কম্পিউটার, এবং গ্রাফিক্স ডিজাইন বিষয়ক বিভিন্ন কোর্স এই বিভাগের শিক্ষার্থীরা শিক্ষাজীবনের বিভিন্ন সময় শিখে আসেন। 

বিসিএস পরীক্ষায় শিক্ষা ক্যাডারে আবেদন করার ক্ষেত্রেও এ বিভাগের শিক্ষার্থীরা সুযোগ বঞ্চিত হন। এ ছাড়াও বাংলাদেশের মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তর এবং এই বিষয় সংশ্লিষ্ট যেসব দপ্তর এবং প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেখানেও সেই হিসেবে এই বিভাগে শিক্ষার্থীদের কাজের পরিবেশ ও সুযোগ এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। নিয়োগ ও খুব একটা দেখা যায় না বললেই চলে।

সিকিউরিটি প্রিন্টিং এবং স্পেশালাইজড পাবলিশিংয়ের ওপরও এই বিভাগের শিক্ষার্থীরা স্নাতকোত্তর পর্যায়ে জ্ঞান অর্জন করেন। পরবর্তীতে তাদের এই জ্ঞান বাস্তবিক এবং ব্যবহারিক পর্যায়ে প্রতিফলন করার সুযোগ কি আদৌ তৈরি হয়েছে? এ ছাড়াও কমার্শিয়াল প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং সংক্রান্ত বিষয়েও হাতে-কলমে এই বিভাগের শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহণ করেন। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত এই বিশেষায়িত হাতে-কলমের শিক্ষা বাস্তবায়নের সুযোগ খুব একটা তৈরি হয়নি। কম বেতনে বেশি খাটিয়ে নেওয়ার প্রবণতা এবং নতুন কর্মজীবনে প্রবেশ করা শিক্ষার্থীকে তার অর্জিত জ্ঞান ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগ করে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সময় ও সুযোগ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে না। যার ফলে বিশেষায়িত জ্ঞান থাকার পরও এসব শিক্ষার্থীদের অন্য কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে হয়। যা সত্যিকার অর্থেই দেশের অর্থ, জ্ঞান ও মেধাশক্তির অপচয়। 

একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় মিডিয়া কমিউনিকেশন কিংবা জার্নালিজম নামের বিভাগে সরাসরি জার্নালিজম পয়ে আসা শিক্ষার্থী কিংবা ফিল্ম, টেলিভিশন অ্যান্ড মিডিয়া নিয়ে পরে আসা শিক্ষার্থীরা আবেদন করতে পারলেও, প্রাসঙ্গিক হওয়ার পরেও প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থীরা আবেদন করার সুযোগ পান না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই বিভাগের নাম চাকরির বিজ্ঞাপনেই থাকে না। যদিও এই বিভাগে শিক্ষার্থীদের স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ের বিভিন্ন কোর্সে কমিউনিকেশন, বিজনেস কমিউনিকেশন, অ্যাডভারটাইজিং এবং পাবলিক রিলেশন নিয়ে পড়ানো হয়। 

বিভিন্ন সরকারি চাকরির বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে সামরিক বাহিনীতেও বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে গণযোগাযোগ এবং সাংবাদিকতা (ম্যাস কমিউনিকেশন অ্যান্ড জার্নালিজম) এর নাম উল্লেখ থাকলেও প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশনের নাম দেখা যায় না। জনসংযোগ কর্মকর্তা (পাবলিক রিলেশন অফিসার) নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রেও প্রাধান্য দেওয়া হয় বাংলা, ইংরেজি, কিংবা গণযোগাযোগ এবং সাংবাদিকতা পড়ে আসা শিক্ষার্থীদের। নিয়োগ বিজ্ঞাপনেও এসব বিভাগের নামই শুধু উল্লেখ থাকে। কিন্তু প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন স্টাডিজে এমন ছেচল্লিশ ক্রেডিটের কোর্স পড়ানো হয়, যা সরাসরি কিংবা আংশিকভাবে গণযোগাযোগ এবং সাংবাদিকতা বিভাগের কারিকুলামের সঙ্গে সঙ্গতিশীল।

গবেষণা ক্ষেত্রেও এ বিভাগের শিক্ষার্থীরা সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অন্যান্য বিভাগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলছে। স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর উভয় পর্যায়েই এই বিভাগের শিক্ষার্থীরা কোর্স ওয়ার্কের অংশ হিসেবে গবেষণা করেন এবং গবেষণা সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় শিখেন। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা কর্মকর্তা নিয়োগের বিজ্ঞাপনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অন্যান্য বিভাগের নাম উল্লেখ থাকলেও, প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন স্টাডিজ বিভাগের নাম উল্লেখ থাকে না।

সুতরাং বলা যায়, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই বিভাগের শিক্ষার্থীদেরও বৈষম্য শিকার হতে হচ্ছে। দেশের সংশ্লিষ্ট খাত এবং খাত সংশ্লিষ্ট বিভাগ থাকা সত্ত্বেও অজ্ঞতা এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে কারিকুলাম সম্পর্কে স্পষ্ট জ্ঞান না থাকার কারণে এ বিভাগের শিক্ষার্থীরা চাকরি ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন, যা মোটেও কাম্য নয়।

নাফিউ সাজিদ জয়, লেখক ও গবেষক