আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে অর্থ মন্ত্রণালয় বাজেটসংক্রান্ত ক্যালেন্ডারে পরিবর্তনের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটি নিঃসন্দেহে একটি সময়োপযোগী ও দূরদর্শী পদক্ষেপ। নির্বাচনের সময় সাধারণত প্রশাসনিক কার্যক্রম ও বাজেট প্রণয়নের মতো জটিল কাজ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এবার অর্থ মন্ত্রণালয় সেই আশঙ্কা মাথায় রেখে কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের সভা এক মাস এবং সংশোধিত বাজেট প্রণয়ন দুই মাস আগে সম্পন্ন করতে চাইছে। এতে যেমন অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণে গতি আসবে, তেমনি নির্বাচনের সময়ে বাজেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিয়ে কোনো অনিশ্চয়তা তৈরি হবে না।
নির্বাচন কমিশনের জন্য চলতি অর্থবছরের বাজেটে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি। এতে ভোটার তালিকা হালনাগাদ, ব্যালট পেপার মুদ্রণ, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, অমোচনীয় কালি থেকে শুরু করে প্রশাসনিক ব্যয় পর্যন্ত সব খাতে পর্যাপ্ত অর্থায়ন নিশ্চিত হবে। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা এরই মধ্যে জানিয়েছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্য তাদের বিপুল পরিমাণ কেনাকাটার প্রয়োজন হয়। এগুলো সময়মতো সম্পন্ন করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ইতিবাচক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অর্থনীতির আরেকটি বড় সিদ্ধান্ত হলো, সমস্যাগ্রস্ত পাঁচটি ইসলামি ধারার ব্যাংক একীভূত করে একটি শক্তিশালী ব্যাংক গঠন করার উদ্যোগ। বহুদিন ধরে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং এক্সিম ব্যাংকের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে নানা সমালোচনা চলছিল। এ ব্যাংকগুলো একত্র করে একটি নতুন শক্তিশালী ইসলামী ব্যাংক গঠন করা হলে শুধু আর্থিক শৃঙ্খলাই ফিরবে না, বরং গ্রাহকের আস্থাও পুনর্গঠিত হবে। সরকারের প্রাথমিক মূলধন জোগান হবে ২০ হাজার ২০০ কোটি টাকা, যা ধাপে ধাপে দেওয়া হবে। ফলে নতুন ব্যাংকটির মোট মূলধন দাঁড়াবে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা, যা একে দেশের সবচেয়ে বড় ইসলামী ব্যাংকে পরিণত করবে। এটি নিঃসন্দেহে ব্যাংকিং খাতের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা।
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, অর্থ মন্ত্রণালয় এই বিপুল অর্থ একসঙ্গে না দিয়ে বাস্তবসম্মত কৌশল নিয়েছে। প্রথমত, বাজেটের অব্যবহৃত বরাদ্দ একত্রিত করে নতুন ব্যাংকের জন্য অর্থ দেওয়া হবে। দ্বিতীয়ত, প্রয়োজনে ট্রেজারি বিল বিক্রির মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা হবে। এতে সরকারকে অতিরিক্ত চাপ নিতে হবে না, আবার দ্রুত সময়ে প্রয়োজনীয় অর্থও পাওয়া যাবে। এ ধরনের কৌশল প্রমাণ করে, সরকার শুধু সমস্যার সমাধানই নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক স্থিতিশীলতাকেও গুরুত্ব দিচ্ছে।
নির্বাচন কমিশনের সুষ্ঠু কার্যক্রম নিশ্চিত করা যেমন গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য, তেমনি আর্থিক খাতকে স্থিতিশীল করা দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত জরুরি। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলে জনগণের আস্থা দৃঢ় হবে, আর শক্তিশালী ব্যাংকিং খাত অর্থনৈতিক কর্মকা-কে গতিশীল করবে। দুই ক্ষেত্রেই সরকারের ইতিবাচক উদ্যোগ প্রশংসার যোগ্য।
অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, নির্বাচনের সময়ে অর্থনৈতিক কার্যক্রম প্রায়ই স্থবির হয়ে পড়ে। কিন্তু এবার অর্থ মন্ত্রণালয় এবং নির্বাচন কমিশনের সমন্বিত প্রস্তুতি এ পরিস্থিতিকে বদলে দিতে পারে। আগেভাগে বাজেট প্রণয়ন ও অর্থ জোগাড়ের পরিকল্পনা নেওয়ায় দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা- স্বাভাবিক ধারায় থাকবে। একই সঙ্গে নির্বাচনকালীন প্রশাসনিক ব্যয়ের চাপও সামাল দেওয়া সহজ হবে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, সরকার দুটি বড় খাতে একসঙ্গে যে ইতিবাচক ও সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে তা একদিকে নির্বাচনের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ নিশ্চিত করা, অন্যদিকে ব্যাংক খাতে আস্থা ফিরিয়ে আনা। এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও অর্থনীতির জন্য সুসংবাদ বয়ে আনতে পারে। স্বচ্ছ নির্বাচন ও শক্তিশালী ব্যাংকিং ব্যবস্থা এই দুই ভিত্তি আমাদের জাতীয় উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
আমরা মনে করি, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তকে কেবল প্রশাসনিক আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে নয়, বরং দেশের ভবিষ্যতের জন্য একটি কৌশলগত বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে। তবেই গণতন্ত্র ও অর্থনীতির এ সমন্বিত পথচলাই আগামী দিনের বাংলাদেশকে আরও স্থিতিশীল ও উন্নয়নমুখী করবে।