ঢাকা মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

প্রযুক্তির ভুল ব্যবহার ও সামাজিক হুমকি

মো. নূর হামজা পিয়াস
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৫, ১১:৩৮ পিএম

এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলেন আপনার সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অন্য কারো দখলে চলে গেছে, তখন প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছেন না। মনে হচ্ছে এটি যেন একটি দুর্ভাগ্যজনক স্বপ্ন। কিন্তু বাস্তবতা এই যে, বর্তমান ডিজিটাল যুগে আমাদের দৈনন্দিন জীবন প্রযুক্তির ওপর এতটাই নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে যে, প্রযুক্তির ভুল ব্যবহার কেবল ব্যক্তিগত জীবনে নয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাতেও বড় হুমকি তৈরি করতে পারে। আমাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, ব্যক্তিগত পরিচয়, মানসিক শান্তি এবং সম্পর্ক সবই এর দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে।

আজকের যুগে প্রযুক্তি আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা, বিনোদন এবং যোগাযোগ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযুক্তি আমাদের জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু যেমন একটি ধারালো ছুরি মানুষের জন্য উপকারী হতে পারে, তেমনি তা ভুল হাতে গেলে বিপজ্জনক। হ্যাকিং, ডেটা চুরি, অনলাইন প্রতারণা এবং ম্যালওয়্যার আক্রমণ প্রতিদিন আমাদের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, ডিজিটাল লেনদেন বা অনলাইন শপিংয়ের মাধ্যমে সহজে অর্থের অপচয় বা চুরি ঘটতে পারে, যা ব্যক্তি ও পরিবারকে আর্থিকভাবে প্রভাবিত করে।

বাংলাদেশে সাইবার অপরাধের পরিমাণ ক্রমবর্ধমান। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের ২০২৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, চলতি বছর প্রথম অষ্টমাসে প্রায় ৫ হাজারের বেশি সাইবার অপরাধের মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে অনলাইন ব্যাংকিং চুরি, প্রতারণামূলক লেনদেন, ফেক অ্যাকাউন্ট তৈরি এবং হ্যাকিং-ভিত্তিক অপরাধ উল্লেখযোগ্য। শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, এই অপরাধগুলো সামাজিক সম্পর্ক, বিশ্বাস এবং মানসিক শান্তিও ভেঙে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, এক তরুণীর ফেক সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে তার পরিচিতদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এতে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়নি, মানসিক চাপও বৃদ্ধি পেয়েছে।

সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়া খবর ছড়ানোও একটি বড় সামাজিক হুমকি। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের ২০২৫ সালের রিপোর্টে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ভুয়া তথ্য শনাক্তের সংখ্যা ৩৪০-এর বেশি। এর মধ্যে রাজনৈতিক সংবাদ প্রধান লক্ষ্যবস্তু, কিন্তু ধর্ম, বিনোদন, কূটনীতি, অর্থনীতি এবং পরিবেশ-সংক্রান্ত ভুয়া তথ্যও প্রচুর। ভুয়া খবর মানুষের মানসিকতা এবং সামাজিক সম্পর্ককে ভেঙে দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, বিদেশে বাংলাদেশি নাগরিকদের প্রতি অবিচার হওয়ার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল, যা পরে পুরোনো এবং ভুল হিসাবে প্রমাণিত হয়। তবুও এটি সামাজিক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে।

প্রযুক্তির ভুল ব্যবহার কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতি বা সামাজিক বিভ্রান্তি তৈরি করে না, এটি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলে। হ্যাকিং, অনলাইন প্রতারণা এবং ভুয়া তথ্যের কারণে মানুষ উদ্বিগ্ন, হতাশ এবং অনিদ্রায় ভুগতে শুরু করে। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রযুক্তি সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা এবং অনলাইন হুমকির কারণে মানসিক চাপের মুখোমুখি। এটি সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং আত্মবিশ্বাস হ্রাসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ডিজিটাল অর্থনৈতিক চুরি বা ব্যাংকিং হ্যাকিংয়ের কারণে শুধু ব্যক্তি নয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেশের কিছু ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ অনলাইন প্রতারণার কারণে লাখ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার না হলে এই সমস্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাবে। অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি, সামাজিক বিশ্বাসও হ্রাস পায়, কারণ মানুষ ডিজিটাল লেনদেনে বিশ্বাস রাখতে ভয় পায়।

প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে শিক্ষার্থীদের এবং যুব সমাজকে সচেতন করতে হবে। স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা, সাইবার নিরাপত্তা এবং অনলাইন আচরণের প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি। শিক্ষার্থীদের দুইটি বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। প্রথম, ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা এবং দ্বিতীয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় তথ্য যাচাই করে শেয়ার করা। শিক্ষার্থীরা যেন জানতে পারে, যে কোনো তথ্য যাচাই ছাড়া শেয়ার করা মানে নিজের এবং অন্যের জীবনের ওপর হুমকি সৃষ্টি করা।

বাংলাদেশ সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তার জন্য আইন প্রণয়ন করেছে। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের আওতায় সাইবার অপরাধ মোকাবিলার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে আইন থাকলেও বাস্তবায়ন পর্যাপ্ত নয়। প্রায়ই অপরাধীরা শনাক্ত হয় না বা বিচারের মুখোমুখি হয় না। তাই প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি, সাইবার পুলিশ প্রস্তুত করা এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে।

সোশ্যাল মিডিয়া এবং অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের কোম্পানিরও দায়িত্ব আছে। ব্যবহারকারীর তথ্য সুরক্ষা, ভুয়া খবর চিহ্নিত করা এবং অনলাইন প্রতারণা রোধের জন্য প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা নিতে হবে। স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও ব্যবহারকারীর তথ্য সুরক্ষায় সচেতন হতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, ফেসবুক এবং গুগল তাদের ব্যবহারকারীর ডেটা সুরক্ষার জন্য নিয়মিত আপডেট এবং ফিল্টার প্রয়োগ করে থাকে।

প্রযুক্তির ভুল ব্যবহার আমাদের সামাজিক সম্পর্ককেও প্রভাবিত করছে। হ্যাকিং, অনলাইন গুজব এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় অবমাননাকর তথ্যের কারণে বন্ধু, পরিবার এবং সহকর্মীদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ভেঙে যাচ্ছে। একটি ছোট ভুল বোঝাবুঝি বা অনলাইন ট্রলিংয়ের কারণে সম্পর্কের দৃঢ়তা ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং মানুষ মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন বোধ করতে শুরু করে। ভার্চুয়াল জগতে আমরা যত বেশি সময় ব্যয় করছি, বাস্তব-জীবনের সম্পর্ক ততটাই দুর্বল হচ্ছে।

ডিজিটাল যুগে উদ্যোক্তারা প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেন। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নিরাপদ লেনদেন, তথ্য যাচাই এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব। যেসব ংঃধৎঃঁঢ় বা উদ্যোক্তা সাইবার নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কাজ করছেন, তাদের উৎসাহিত করা উচিত।  তারা নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে পারেন যা মানুষকে প্রতারণা থেকে রক্ষা করবে এবং একটি শক্তিশালী ডিজিটাল অর্থনীতি গঠনে সহায়তা করবে।

প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে নৈতিকতার অভাবও একটি বড় সমস্যা। অনেক সময় মানুষ অনলাইন ট্রলিং, ভুয়া খবর বা কপিরাইট লঙ্ঘন করে অন্যের ক্ষতি করে। ডিজিটাল নৈতিকতা রক্ষা না করলে সমাজে অনৈতিকতা বৃদ্ধি পায়, যা দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক অস্থিতিশীলতার কারণ হতে পারে।

স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত, যা শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল নিরাপত্তা, অনলাইন আচরণ এবং তথ্য যাচাইয়ের ওপর কেন্দ্রীভূত। এতে তারা প্রযুক্তির সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে, তবে সতর্কতার সঙ্গে। উদাহরণস্বরূপ, অনলাইনে একটি লেনদেন বা সোশ্যাল মিডিয়ায় তথ্য শেয়ার করার আগে যাচাই করা অভ্যাস গড়ে উঠবে।

প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার যুব সমাজে আসক্তি তৈরি করছে। প্রায় ৭০ শতাংশ তরুণ তাদের দৈনন্দিন সময়ের বড় অংশ সামাজিক মিডিয়ায় কাটাচ্ছে। এটি ঘুমের সমস্যা, একঘেয়েমি, মনোযোগ কমানো এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করছে। অনলাইন শিক্ষার সুবিধা থাকলেও, প্রতারণা ও ভুয়া কোর্সের মাধ্যমে অর্থ এবং সময় নষ্ট হচ্ছে। শিক্ষার্থী শিক্ষার পরিবর্তে প্রতারণার শিকার হচ্ছে। প্রযুক্তির সুবিধা নেওয়া যায়, তবে সঠিক ব্যবহার ও সচেতনতা না থাকলে সামাজিক ও মানসিক ক্ষতি হয়।

প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে সহজ করেছে, কিন্তু ভুল ব্যবহারের কারণে এটি সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং মানসিক হুমকির উৎস হয়ে উঠেছে। সঠিক ব্যবহার, সচেতনতা, শিক্ষা এবং সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ মিলিয়ে প্রযুক্তিকে আমাদের সুরক্ষার হাতিয়ার হিসেবে রূপান্তরিত করতে হবে। যুব সমাজকে সচেতন করে, নিরাপদ ডিজিটাল ব্যবস্থার মাধ্যমে আমরা এই হুমকি কমাতে পারি।
 

মো. নূর হামজা পিয়াস
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ
ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ