শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


শাহ সুহেল আহমদ

প্রকাশিত: অক্টোবর ৩, ২০২৫, ০৩:৩১ এএম

গাজা যুদ্ধ ও ম্যাক্রোঁর কূটনৈতিক সাহস

শাহ সুহেল আহমদ

প্রকাশিত: অক্টোবর ৩, ২০২৫, ০৩:৩১ এএম

গাজা যুদ্ধ ও ম্যাক্রোঁর কূটনৈতিক সাহস

গাজা যুদ্ধের ভয়াবহতায় তখন বিশ্বজুড়ে সাধারণ মানুষ আন্দোলনে মুখর। রাস্তায় মিছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ, সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভ। সবখানেই ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আওয়াজ। কিন্তু বিশ্বনেতারা, বিশেষত পশ্চিমা শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর প্রধানরা তখন নীরব। 

যুক্তরাষ্ট্রকে বিরক্ত করার ভয়ে কেউ ইসরায়েলকে প্রকাশ্যে যুদ্ধ থামাতে বলতেও সাহস পাচ্ছিলেন না। ঠিক সেই সময় হঠাৎ করেই কূটনৈতিক নীরবতা ভেঙে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ঘোষণা দিলেন ‘ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে ফ্রান্স।’ এমন ঘোষণায় নড়েচড়ে বসেন বিশ্বনেতারা। সঙ্গে যোগ হয় যুক্তরাজ্য, কানাডা, স্পেনসহ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর একই মনোভাব। 

২০২৫-এর শুরুর দিকে ম্যাক্রোঁর এমন ঘোষণার পর কূটনৈতিক নানা মেরুকরণে সেটি আবার স্থগিত হয়। শুরু হয় ফিরতি আলোচনা। ২৪ জুলাই ম্যাক্রোঁর অফিসিয়ালি পরিপত্র জারি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেই আবার একই ঘোষণা দেন। বলেন- ‘সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে সেটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবেন।’

গাজা উপত্যকায় ২০২৩ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া সংঘাত ইতোমধ্যে একবিংশ শতাব্দীর ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নিয়েছে।

গত দুই বছরে ইসরায়েলি হামলায় নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা ৬৫ হাজার ছাড়িয়েছে। আহত ১ লাখ ৬৬ হাজার ৭৯৫ জন। নিখোঁজ বহু মানুষ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে। শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন জানায়, নিহতদের মধ্যে অন্তত ২০ হাজার শিশু রয়েছে। হাসপাতাল, স্কুল ও আশ্রয়কেন্দ্র ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন। দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধবিরতির আহ্বান বারবার উঠলেও কার্যকর সমাধান পাওয়া যায়নি।

এই প্রেক্ষাপটে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সাম্প্রতিক সময়ে সাহসী কূটনৈতিক অবস্থান সত্যিই প্রশংসনীয়। তিনি তখন যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাননি, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্বীকৃতির মতো ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়েছেন, যা ভবিষ্যতের শান্তি প্রক্রিয়ার জন্য একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।

গত ২৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে ম্যাক্রোঁ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দেন। তার ভাষ্যে তিনি স্পষ্ট করেন- ‘একটি স্বাধীন ও টেকসই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি সম্ভব নয়।’ এই ঘোষণার মাধ্যমে ফ্রান্স ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রথম বড় শক্তি হিসেবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে পূর্ণাঙ্গ স্বীকৃতি দিল। পশ্চিম তীর, গাজা ও পূর্ব জেরুজালেমকে অন্তর্ভুক্ত করে রাষ্ট্র স্বীকৃতির এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক মহলে আলোড়ন তোলে।

এর আগে-পরে অন্তত ১১টি দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র ঘোষণা করে। সবাই ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র ঘোষণা করে হয়তো কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিচ্ছেন। এটাই হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এতেও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ আবারও ব্যতিক্রম। তিনি পরদিনই ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করে গাজা যুদ্ধ বন্ধের অনুরোধ জানান। এমন কি মজার ছলে হলেও বলে দেন- ‘ট্রাম্পকে নোবেল পেতে হলে গাজা যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে’।

বৈঠক শেষে ম্যাক্রোঁ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন অসম্ভব। মানবিক বিপর্যয় ঠেকাতে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।’ এই বক্তব্য স্পষ্ট করে, ম্যাক্রোঁ শুধু প্রতীকী ভাষণেই সীমাবদ্ধ থাকছেন না, বিশ্ব শক্তিগুলোকে সরাসরি সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করছেন।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রকে পাশে না পেলে যুদ্ধবিরতির উদ্যোগ কার্যত অকার্যকর থেকে যায়। তাই ফরাসি প্রেসিডেন্টের এই কূটনৈতিক চাপ ছিল সময়োপযোগী এবং কৌশলগতভাবে সঠিক।

প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সাম্প্রতিক কূটনৈতিক অবস্থানকে মূলত চারটি স্তরে দেখা যায়। তবে এর মধ্যে কিছু পদক্ষেপ ইতোমধ্যেই বাস্তবায়িত, কিছু আবার পরিকল্পনার পর্যায়ে রয়েছে।

১. অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও মানবিক সহায়তা ম্যাক্রোঁ বারবার বলেছেন, গাজার জনগণের জন্য খাদ্য, পানি ও ওষুধ প্রবাহ অবিলম্বে নিশ্চিত করতে হবে। ফ্রান্স ইতোমধ্যেই গাজায় জরুরি চিকিৎসা সামগ্রী পাঠিয়েছে। 

২. বন্দিমুক্তি ও আস্থা পুনর্গঠন
আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনায় আছে- ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাসের হাতে আটক ইসরায়েলি নাগরিকদের মুক্তি ও ইসরায়েলের নির্বিচার সামরিক অভিযান বন্ধকে সমান্তরাল প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা দরকার। যদিও ম্যাক্রোঁ সরাসরি এভাবে শর্ত দিয়েছেন- এমন স্পষ্ট প্রমাণ মেলেনি, তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন তার কূটনৈতিক অবস্থানে এই দিকটি নিহিত রয়েছে।

৩. আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন ম্যাক্রোঁ ফিলিস্তিন প্রশ্নে একটি আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনের পরিকল্পনার কথা বলেছেন এবং যুক্তরাজ্য ও কানাডার সঙ্গেও যৌথভাবে বিবৃতি দিয়েছেন। এ ছাড়া গাজা সংকট নিয়ে প্যারিসে একাধিক কূটনৈতিক বৈঠক ও মানবিক সম্মেলন আয়োজনের উদ্যোগ দেখা গেছে। যদিও এখনো পূর্ণাঙ্গ শান্তি সম্মেলন কার্যকর হয়নি। ধরা যায় এটি প্রস্তুতির পর্যায়ে রয়েছে।

৪. ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি
সবচেয়ে আলোচিত পদক্ষেপ হলো ফ্রান্সের পক্ষ থেকে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া। এ ঘোষণার পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক সাড়া পড়ে এবং আরও কয়েকটি দেশ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়।

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ২০২৪ সালের ২৫ মার্চ রেজ্যুলেশন ২৭২৮ পাস করে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানায়। কিন্তু ইসরায়েল প্রস্তাব কার্যকর করেনি। যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, হামাসকে আগে নিরস্ত্র হতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে ফ্রান্সের অবস্থান স্পষ্টতই ছিল ভিন্ন।

ফ্রান্স ঐতিহাসিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যে ভারসাম্যপূর্ণ ভূমিকা নিতে চেয়েছে বারবার। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর প্রেসিডেন্ট শার্ল দ্য গোল প্রকাশ্যে ইসরায়েলের সমালোচনা করেছিলেন। ১৯৯৬ সালে জেরুজালেম সফরে প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাক ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে উত্তপ্ত বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। ফিলিস্তিনে দমননীতির বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নেন। ম্যাক্রোঁর সাম্প্রতিক পদক্ষেপ সেই ধারাবাহিকতাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে।

ফরাসি প্রেসিডেন্টের সাম্প্রতিক ভাষণ ও কূটনৈতিক উদ্যোগকে অনেকেই তুলনা করছেন নরওয়ের অসলো চুক্তির (১৯৯৩) সঙ্গে, যা একসময় ফিলিস্তিন শান্তি প্রক্রিয়ায় আশার আলো জ্বালিয়েছিল। যদি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয় এবং রাজনৈতিক সমাধানের পথ উন্মুক্ত হয়, তবে এটি নিঃসন্দেহে ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এমনকি ব্যর্থ হলেও, মানবিক বিপর্যয়ের মুহূর্তে নৈতিক ও কূটনৈতিক সাহস দেখানোর উদাহরণ হিসেবে এই উদ্যোগ স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

এ রকম একজন রাষ্ট্রপ্রধানের কূটনৈতিক ভিশন কতটা প্রভাব ফেলতে পারে, তার সাক্ষী ইতিহাসও। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের মধ্যস্থতায় মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ১৯৭৮ সালে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি করেন, যা আরব-ইসরায়েল সম্পর্কের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। আবার পশ্চিমা শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর চাপ ও আন্তর্জাতিক বয়কট নীতির কারণে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার ১৯৯০-এর দশকে নেলসন ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়, যা অ্যাপারথাইড অবসানের পথ প্রশস্ত করে। একইভাবে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের ফোরটিন পয়েন্টস (১৯১৮) পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থার ভিত্তি রচনায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল।

যুদ্ধবিরতি, মানবিক সহায়তা ও রাষ্ট্র স্বীকৃতির মতো পদক্ষেপ তার নীতিকে বৈশ্বিকভাবে আলোচিত করেছে। ফলাফল যাই হোক, ইতিহাসে এটি প্রমাণ হয়ে থাকবে যে মানবিক বিপর্যয়ের সময় একজন নেতার দৃঢ় কূটনৈতিক অবস্থান কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

শাহ সুহেল আহমদ, সম্পাদক, বাংলা টেলিগ্রাম, ফ্রান্স

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!