রাষ্ট্রে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ চারটি স্তম্ভ বা পিলার বা খুঁটি। প্রথমে জনগণ গণতান্ত্রিক পন্থায় ভোট দিয়ে সাংসদ বা সংসদ সদস্য নির্বাচন করবে। এর পর তারা সংসদে গিয়ে একটি সরকার ব্যবস্থা বা পার্লামেন্ট গঠন করবে। পার্লামেন্ট জনগণের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শান্তি, স্বস্তি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানের লক্ষ্যে প্রস্তাব উত্থাপন করে বিল পাস করবে। এভাবে সংসদ বা পার্লামেন্ট বা সরকার ব্যবস্থা হলো দেশ বা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ও প্রথম স্তম্ভ। উত্থাপিত ও পাসকৃত বিল বা সেবাসমূহ জনগণের মাঝে সুষম বণ্টন প্রক্রিয়ায় প্রশাসনিক বিভাগ নামে একটি স্তম্ভ খোলা থাকে। যারা সরকার ও জনগণের মাঝে একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বজায় রাখতে সচেষ্ট। সরকার থেকে কর্ম ও সেবাসমূহ জনগণকে প্রদান করে। আবার জনগণের সেবা ও নিরাপত্তা বিধানের নিশ্চয়তায় ট্যাক্স বা ভ্যাট আদায় করে সরকারকে সহযোগিতা করে। এই প্রশাসনিক ব্যবস্থা হলো দেশ বা রাষ্ট্রের দ্বিতীয় স্তম্ভ। তৃতীয়ত; জনস্বার্থ যথাযথ নিশ্চিত হয়েছে কিনা সেক্ষেত্রে সরকার ও প্রশাসনের খুঁত ধরার কাজ হচ্ছে বিচার বিভাগ বা আপিল বিভাগের। আবার সরকারি সেবাসমূহ গ্রহণপূর্বক বিনিময় কৃতার্থ ও কৃতজ্ঞতা স্বরূপ রাষ্ট্রে শান্তি, শৃঙ্খলা বজায় রেখে জনগণ চলছে কি-না যা দেখে প্রকৃত রায় দেওয়ার কাজ হচ্ছে এই স্তম্ভের।
রাষ্ট্রের সরকার, সংসদ, প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও আপিল বিভাগের কর্ম ও সেবাসমূহের যোগ্যতাভিত্তিক প্রতি সেকেন্ডের ফিরিস্তি গোটা জাতির সম্মুখে প্রচার ও প্রকাশের কাজ হচ্ছে তথ্য ও সম্প্রচারের। যে কাজটি করে থাকে সংবাদ ও গণমাধ্যম। সংবাদ মাধ্যমে শুধু জনগণ উপকৃত হয় তা নয়। সরকার, প্রশাসন, বিচার বিভাগ সর্বক্ষত্রের চোখ ও কান সজাগ রাখে এই স্তম্ভটি। অন্য স্তম্ভগুলোর মতো এটিও জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত সীমাবদ্ধ না থেকে আন্তর্জাতিক কলেবরে দিক নির্দেশনায় মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে কাজ করে।
থমাস জেফারসন ছিলেন মার্কিন মুলুকের একজন অন্যতম ব্যক্তি। যিনি কিনা যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের রচয়িতা ছিলেন। তথ্য ও সম্প্রচারের গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে যদি বিকল্পটি দেওয়া হয় যে তুমি কি সংবাদপত্রবিহীন সরকার চাও, না সরকারবিহীন সংবাদপত্র চাও? তখন আমি পরেরটা বেছে নেব।’
থমাস জেফারসনের কথার মর্ম হলো- গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবাদপত্রের ভূমিকা। তিনি মূলত বস্তুনিষ্ঠ, তথ্যবহুল, নির্ভরযোগ্য সংবাদ ও স্বাধীন সাংবাদিকতা বুঝিয়েছেন। আবার স্বাধীন সাংবাদিকতা বলতে একপেশে, অসত্য, মিথ্যা-বানোয়াট, ভিত্তিহীন সংবাদ নয়। সঠিক সংবাদের জন্য প্রয়োজন স্বচ্ছ নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা। অশিক্ষিত, অর্ধ শিক্ষিতদের হাতে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা ছেড়ে দিলে সে দেশ রসাতলে যাবে নিশ্চিত। আবার, রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার অতিমাত্রায় হস্তক্ষেপের ফল শুভ নয়। আজ হোক কাল হোক তার পরিণাম ভোগ করতেই হয়। যেমন- নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন বলেছেন ‘কোনো দেশে স্বাধীন গণমাধ্যম থাকলে সে দেশে দুর্ভিক্ষ হানা দিতে পারে না।’ অমর্ত্য সেনের কথা বিফলে যায় না। যখন সংবাদ মাধ্যমের গলদেশ চেপে ধরা হয় তখন প্রকৃত সত্য আড়াল হয়ে যায়। প্রকারন্তে দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা বেড়ে এক সময় খড়ার উপদ্রব হয়। যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পতিত আ’লীগ সরকার। যারা কী না গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের হিসেবের খাতা থেকে বাদ দিয়েছিল। রাষ্ট্র যন্ত্রের গণমাধ্যম নামক ইঞ্জিনের রিমোট কন্ট্রোলের দায়িত্বে ছিল কতিপয় মন্ত্রী। রাষ্ট্রের প্রত্যেকটা সেক্টরের প্রকৃত সত্যটা আড়াল হতে হতে এক সময় খড়ার উপদ্রব সৃষ্টি হয়েছিল। পরিশেষে, ২৪-এর আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানের ইতিহাস সৃষ্টি হলো।
সমগ্র জাতি চিৎকার দিয়ে স্বীকার করছেন সাংবাদিক জাতির আয়না। সাংবাদিক জাতির প্রতিচ্ছবি। হ্যাঁ একটি রাষ্ট্রে যেমন সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিক সূর্যের আলো প্রজ¦লিত করে রাখে তেমনি একদিনের জন্য ইলেক্ট্রিক, মুদ্রণ মিডিয়া কর্ম বিরতি রাখুক। গোটা রাষ্ট্রে বিদ্যুৎবিহীন যেমন একধরনের হতাশার সৃষ্টি হয়। ঠিক তার চেয়েও বেশি অনুকম্পন হবে গোটা জাতির ভেতরে। ধকল পড়বে বিচার বিভাগে, স্থবির হয়ে যাবে প্রশাসনিক কর্মকা-, থমকে যাবে সরকার, হতাশায় পতিত হয়ে যাবে জনগণ, বিকল হবে আন্তর্জাতিক পরিম-ল।
সেই গল্পটি কার না জানা আছে। একবার শরীরের সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ধর্মঘট ডাক দিল পেট বা বেলির বিরুদ্ধে। হাত বলে আমি যা কিছু মুখে পুড়ে দেই সবকিছু পেটে যায়। আর পেট খেয়ে খেয়ে দিন দিন ভুঁড়ি বাড়াচ্ছে। আর নয় খাবার। মুখ কত কষ্ট করে চর্বণ করে, জিহ্বা স্বাদ নেয়, গলা গিলে পেটে পাঠায়। দুই পা ডেকে বলে তাই তো আমি হেঁটে হেঁটে খাবার এনে দেই। মস্তিষ্ক বলে বুদ্ধি ও পরিকল্পনা আমার। চোখ বলে আমিই তো দেখি। নাকের সাফ কথা আমি ঘ্রাণ নেই। কান থেমে থাকবে কেন। আমি শুনে নেই। এভাবে সবাই একজোট হলো পেটকে আর খাবার নয়। খাবার দেওয়া বন্ধ। কয়েক ঘণ্টা পার হতেই গলা শুকানো শুরু হলো। প-িত চোখের দৃষ্টি কমতে থাকল। মুখের চোয়াল বসা শুরু হলো। আরও কয়েক ঘণ্টা পার হতে না হতেই পা দুটি দুর্বল হয়ে গেল। হাঁটার শক্তি হারাচ্ছে। কান দিয়ে শো শো শব্দ বের হচ্ছে। আরও কয়েক ঘণ্টা যেতে চৈতন্য হারিয়ে সোজা বিছানায়। এবার সমগ্র শরীর নিস্তেজ। হাত চলছে না। বুদ্ধির ভান্ডার মস্তিষ্ক বা মাথা ঘুরছে। জান বের হয়ে আসছে। এবার ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হলো। ভুল ভাঙল সবার। দোষ পেটের নয়। বরঞ্চ আমরা সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো একটি শরীরেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। এভাবে সকল সেক্টর থেকে সংবাদ মাধ্যম বা সাংবাদিকরা সব সময়ই চোখের শূল হয়ে থাকে। চোখ বুজে একবার ভেবে নিলে বুঝতে সক্ষম হবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যভাবে এদের বিরুদ্ধাচারণ করলে সকল বিভাগই এক প্রকার তার নিজ ভাগ্যের বিড়ম্বনা সৃষ্টি করে। যা পরবর্তীতে নিজেরসহ গোটা জাতিকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়।
বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশে সাংবাদিকতার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছর মেয়াদি স্নাতক সম্মান ও এক বছরের স্নাতকোত্তর পড়ানো হয়। এ ছাড়াও অন্য বিষয় থেকে আগত সাংবাদিকতা পেশায় আগ্রহীদের জন্য আছে বিশেষ কোর্স বা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। অথচ, ইদানীং ব্যাঙের ছাতার মতো অঙ্কুরিত হওয়া কিছু সংবাদপত্র ক্লাস থ্রি পাস, অশিক্ষতদের গলায়ও সাংবাদিকতার কার্ড বা পরিচয়পত্র ঝুলিয়ে দিচ্ছে। লজ্জায় বিবর্ণ হতে হয় শিক্ষিত পেশাধারী সাংবাদিককে। প্রতিটি সেক্টরে প্রশ্নাধীন ও অবমূল্যায়িত হতে হয় প্রকৃত সাংবাদিকদের। যার প্রভাব প্রতিফলিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই থ্রি পাস ফোর পাস কিংবা আধা শিক্ষিত কথিত সাংবাদিকদের কাছে কি আশা করা যেতে পারে?
মফস্বলে সাংবাদিকতার জন্য কোনো সার্টিফিকেশন লাগে না। যে কেউ ইচ্ছা করলে কিছু টাকার বিনিময়ে কিছু পত্রিকা থেকে পরিচয়পত্র এনে সাংবাদিক বনে যায়। এটি এখন যত্রতত্র। যদিও তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে আইন করেছে স্নাতক পাসের নিচে কোনো সাংবাদিক থাকবে না। কই আজও কি এর বাস্তবায়ন হয়েছে?
রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হওয়া সত্ত্বেও আজ সাংবাদিকরা হয়রানি হচ্ছে, মার খাচ্ছে, নিত্যনতুন সংগঠন তৈরি হচ্ছে, অপসাংবাদিকদের হাতে জিম্মি হচ্ছে মূল ধারার সাংবাদিকতা, চাঁদাবাজ সৃষ্টি হচ্ছে। দৌরাত্ম্য বেড়ে যাচ্ছে একদল অশিক্ষিত মূর্খের, কেবল নামে মাত্র সাংবাদিকদের। দিন দিন সম্মান হারাচ্ছে মূল ধারার সাংবাদিকরা।
আবার মফস্বলের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, শিক্ষক যখন সাংবাদিক। শিক্ষকতা যেমন একটি মহান পেশা তেমনি সাংবাদিকতাও মহান পেশা। আবার এই পেশা দুটো সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য ও পৃথক চাকরি বা কর্ম। দুটিই সুবিধাভোগী কাজ। শিক্ষক জাতি গঠনে মোক্ষম ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে জাতিকে সোজা-সাপ্টা পথ দেখায় সাংবাদিক।
সৃজনশীল এই পেশায় প্রচুর সময় দিতে হয়। নিরন্তর চর্চা করতে হয়। সাংবাদিকতা এমনই এক পেশা, অনেক সময় শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হিসেবে কাজ করে।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ সার্বক্ষণিক সাংবাদিকতায় নিয়োজিত থেকে শিক্ষকতা পেশায় চরমভাবে ফাঁকি দিচ্ছেন। যেখানে তারা মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে কাজ করবেন, সেখানে তারা নিজেরাই দুর্নীতি করছেন। দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষকদের কাছে কী আশা করা যায়?
মফস্বলের এই শিক্ষক কাম সাংবাদিক সর্বত্র পরিচয় দেন সাংবাদিক হিসেবে। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরে বেড়ায়। তারা সাংবাদিকতা দোহাই দিয়ে শিক্ষকতার মহান দায়িত্বে ফাঁকি দিয়ে ধোঁকা দিচ্ছেন গোটা সমাজ থেকে রাষ্ট্রকে। অথচ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বেতন-ভাতা কিন্তু নিয়মিত তুলছেন। সাংবাদিকতার ভয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান বা কর্তৃপক্ষ এমনকি প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কেউ কিছু বলার সাহস পান না। ক্লাসে পাঠদান না করেই বেতন-ভাতা নিয়মিত তুলছেন। মানুষ গড়ার কারিগর ব্যক্তিটি দুর্নীতি করছেন, ধোঁকা দিচ্ছেন গোটা জাতিকে।
‘বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের দুর্নীতি রোধে নীতিমালা করা হয়েছে। যেমন, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্কুল ও কলেজের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০২১-২২-এর অনুচ্ছেদ ১১.১৭ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মাদ্রাসার জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০১৮ (২৩ নভেম্বর ২০২০ পর্যন্ত সংশোধিত) এর অনুচ্ছেদ ১১.১০(ক) এবং বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০১৮-এর অনুচ্ছেদ ১৫.১ মোতাবেক এমপিওভুক্ত কোনো শিক্ষক-কর্মচারী একই সঙ্গে একাধিক কোনো পদে-চাকরিতে বা আর্থিক লাভজনক কোনো পদে নিয়োজিত থাকতে পারবে না।’
দেশ যখন সংস্কারের পথে এ বিষয়েরও সংস্কার ও বাস্তব প্রতিফলন হওয়া জরুরি। যে সকল শিক্ষক বা কর্মচারী এ রকম দ্বৈত সুবিধা ভোগ করে রাষ্ট্রের ক্ষতি করছে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
সাংবাদিক নেতা ও সাংবাদিক সংগঠনের জন্য নীতিমালা হওয়া জরুরি। বিধান থাকতে হবে শিক্ষাগত যোগ্যতাভিত্তিক সাংবাদিক, সংবাদ লেখায় এক্সপার্ট, নির্ভুল ভাষা জ্ঞান, আলাদা বিটে অভিজ্ঞ এবং চাঁদাবাজ নয় এমন সাংবাদিকই কেবল সাংবাদিক নেতা হতে পারবে। আইন হতে হবে কেবল মাত্র উপরোক্ত গুণাবলি ও বিশেষত্ব সম্পন্ন সাংবাদিকরাই কেবল সংগঠেন করার যোগ্য বলে বিবেচিত হবে। তাহলে অপসাংবাদিকতা বন্ধ হয়ে সাংবাদিকতার একটি উর্বর ক্ষেত্র তৈরি হবে। মুক্তি পাবে মূলধারার সাংবাদিক।
মল্লিক মাকসুদ আহমেদ বায়েজীদ, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন