ঢাকা বুধবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২৫

শান্তি থাকলেই উন্নতি সম্ভব

সেঁজুতি মুমু, শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৫, ২০২৫, ০১:২৯ এএম

বছর দুই কি তিনেক আগে ভারতীয় টিভি চ্যানেলে সনিতে মহাভারতের অন্যতম চরিত্র কর্ণকে নিয়ে একটি ড্রামা সিরিজ নির্মিত হয়েছিল। সেই ড্রামা সিরিজটার নাম ছিলÑ ‘সূর্যপুত্র কর্ণ’। সেই সিরিজটার শেষ এপিসোডে মহাভারতের স্বর্গারোহণ পর্বের আলোকে নির্মিত একটি দৃশ্য ছিল যেখানে স্বর্গে কৌরবরা, পান্ডবরা আর কর্ণ উপস্থিত, মৃত্যুর পর স্বর্গে সবাই একত্রে হেসে খেলে দিন কাটাচ্ছেন। তখন শ্রীকৃষ্ণ একটা কথা বলেছিলেন, ‘কৌরব পান্ডব ও কর্ণ এই একশ ছয় ভাই যদি পৃথিবীতে মিলেমিশে বসবাস করতেন, তাহলে পৃথিবী হয়ে উঠত স্বর্গ।’

গত কয়েকদিন থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস পড়ে শ্রীকৃষ্ণের বলা ওই উক্তিটি আমার বারবার মনে পড়ছে। জানি না মহাভারত প্রকৃত গ্রন্থে এই উক্তিটি আছে কিনা, তবে উক্তিটি পৃথিবীর প্রতিটি শান্তিপ্রিয় মানুষের মনের অন্যতম বাসনা। মহাভারতের আধারে বলা মাত্র, তবে একটু বিবেচনা করে দেখলে বোঝা যাবে ওই উক্তিটি সাধারণ মানুষের হৃদয়ের বাসনা।

ভেবে দেখুন যদি বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্র শক্তি আর অক্ষ শক্তির দেশগুলো যদি একে অপরের বিরুদ্ধে বিধ্বংসী যুদ্ধে মেতে না উঠে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করত এই ধরণীর বুকে, তাহলে আমাদের পৃথিবী আরও কত উন্নত হতো। পৃথিবী হয়ে উঠত স্বর্গ। হিরোশিমা, নাগাসাকিতে যদি পারমাণবিক বোমা না ফেলা হতো, যদি জাপান-আমেরিকা তথা সব দেশগুলো একত্রে গবেষণার কাজে লিপ্ত হতো এই বিধ্বংসী যুদ্ধের বদলে, তাহলে হয়তো এতদিনে টাইম মেশিন আবিষ্কার করা যেত। টাইম মেশিনের কথাটা অত্যুক্তি করলাম, তবে ভেবে দেখুন তো ক্ষমতার লোভে যদি দেশগুলো এই দুটি বিধ্বংসী যুদ্ধে মেতে না উঠত তাহলে কি আমাদের পৃথিবী জানের দিক দিয়ে, শক্তির দিক দিয়ে আরও কয়েক সহস্র ধাপ এগিয়ে যেত না? যদি হিটলার, রুজভেল্ট, চার্চিল, হিরোহিটো তথা তৎকালীন দেশীয় প্রতিনিধিরা এই পৃথিবীর বুকে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতেন তাহলে কি আমরা আরও অনেক অনেক উন্নত এক পৃথিবী পেতাম না?

ঠিক আরেকটি অন্যতম উদাহরণ হলোÑ ভারতীয় উপমহাদেশ। বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান। ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ লেগেই আছে। আমরা একে অপরকে ছোট করতে ব্যস্ত। ব্রিটিশরা যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করে গেছে। সেই সাম্প্রদায়িকতার স্ফুলিঙ্গে আমরা নিয়মিত ঘি ঢেলেই যাচ্ছি। পৃথক দেশ তাতে কি হয়েছে। যদি আমরা একে অপরকে ছোট দেখানো, গুম, হত্যা এসব বাদ দিয়ে একত্রে শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করতাম, তাহলে আমাদের এই তিনটি দেশ কি ইউরোপীয় অন্য দেশগুলোর মতো উন্নত হতো না? আমার তো মনে হয় আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশে যে সম্পদের ঐশ্বর্য আছে তা মিলেমিশে গবেষণা, শিক্ষা, বাণিজ্যের কাজে ব্যবহার করলে আমরা এই তিন দেশ হতাম অনন্য শক্তিধর, ইউরোপ আমেরিকার অনেক দেশের চেয়ে বেশি শক্তিশালী, সম্পদশালী। কিন্তু বাস্তবতার প্রেক্ষাপট একদম ভিন্ন।

উপরে উল্লিখিত শ্রীকৃষ্ণের উক্তিটি কি এই ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিটি শান্তিপ্রিয় মানুষের মনের কথা নয়? কুরুক্ষেত্রের ভয়াবহ যুদ্ধের বদলে যদি কৌরব পান্ডবরা শান্তিপূর্ণভাবে একত্রে বাস করত, পৃথিবী কি স্বর্গ হতো না?

মহাভারতের আধারে বলা মাত্র, আসল উদ্দেশ্য হলোÑ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মর্ম বোঝা। একবার ভাবুন মানুষ যদি লোভে অহংকারে মত্ত না হয়ে সংযমী হয়, যদি নিজের সমান বা বেশি অথবা কম শক্তিধর প্রতিদ্বন্দ্বীকে শত্রু না ভেবে বন্ধু ভেবে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় তাহলে লাভ বই ক্ষতি হবে না অবশ্যই। কিন্তু আমরা মানুষেরা লোভে, অহংকারে এমনই মত্ত হয়ে আছি যে আমরা নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারছি অথচ তা বুঝছি না। যুদ্ধ বা শত্রুতার কারণে যে আমরা নিজেদের ক্ষতি করছি তা আমরা বুঝতে রাজি নই! উপরন্ত কোনো সুহৃদ ব্যক্তি যদি এ প্রসঙ্গে কথা তোলে উল্টে আমরা তাকে দোষারোপ করতে লেগে যাই!

শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অন্যতম দৃষ্টান্ত হলেনÑ সম্রাট আকবর। তিনি তার রাজত্বকালে রাজপুতদের সঙ্গে শত্রুতার বদলে মিত্রতার পথ বেছে নিয়েছিলেন। এটা তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অন্যতম দৃষ্টান্ত। তার এই সিদ্ধান্তের ফলাফল ইতিহাসে দেখা যায়, বিধ্বংসী যুদ্ধের বদলে মিত্রতার কারণে মুঘল ও রাজপুত উভয়ই কতটা লাভবান হয়েছিলেন। আমি সকল মানব জাতির পক্ষ থেকে এই মানব জাতিকেই আহ্বান জানাচ্ছি হিংস্রতা ছেড়ে, রূঢ়তা ছেড়ে আসুন একে অপরের প্রতি মিত্রতার হাত বাড়িয়ে দেই। একত্রে এই পৃথিবীকে স্বর্গ বানাই।

বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত বাংলাদেশের সম্পর্ক যেভাবে যুদ্ধাংদেহী মনোভাবে পরিণত হচ্ছে এতে কি দুই দেশের কারোরই কোনো লাভ হবে? দোষ কার কে আগে করল, এসব নিয়ে আমার কথা নয়। আমার কথা হচ্ছেÑ কেন আমরা মানুষ হয়ে মানুষেরই রক্তের পিপার্সী হয়ে আছি। এত দাঙ্গা, এত হাঙ্গামার কি অর্থ। আবেগ দিয়ে না ভেবে আমরা বিবেক দিয়ে কেন ভাবছি না? সম্প্রদায়গত বিভেদ এটাকে বড় করে না দেখে যদি আমরা এভাবে ভাবি যে আমরা মানুষ। আমাদের জীবনের মূলমন্ত্র যদি হয়, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। তাহলে কি খুব খারাপ হবে? আসুন মানুষ হই মানবতা শিখি। স্রষ্টার সৃষ্টির সেরা জীব আমরা। আমাদের প্রধান দায়িত্ব একত্রে মিলেমিশে এই দুনিয়াটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। যুদ্ধ শুনলেই মনের ভেতরে যেন অকস্মাৎ ভূমিকম্পের মতো কাঁপুনি ওঠে।

যুদ্ধ শুনলে মনে পড়ে ফিলিস্তিনের নিরীহ বাচ্চাগুলোর ক্ষতবিক্ষত দেহ। মনে পড়ে মায়ের হাহাকার, ভাইয়ের মৃতদেহ, বোনের ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভ্রম, ভেঙে যাওয়া পুড়ে যাওয়া বাড়িঘর, আর্তনাদ, বুভুক্ষু মানুষের চিৎকার। আচ্ছা আমরা মানবিক হতে পারি না? অনেক দেশে তো সীমান্তে কোনো সেনাবাহিনী থাকে না। মানুষ তবুও কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে না। হ্যাঁ এমন দেশ আছে বই কি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো দেখুন। তবুও তাদের মধ্যে হত্যা, গুম, চোরাচালানি নেই। যেমনÑ কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র: পৃথিবীর দীর্ঘতম আন্তর্জাতিক সীমান্ত এটি, যেখানে বেশির ভাগ স্থানেই কাটা তারের বেড়া নেই। দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং উন্মুক্ত সীমান্তের কারণে এই সীমান্তে কাটা তারের বেড়া বা কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থাও নেই। কিন্তু বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের যদি কাটাতার তুলে দেওয়া হয় তাহলে একদিনেই দক্ষযজ্ঞ শুরু হয়ে যাবে, কুরুক্ষেত্রে পরিণত হবে এই উপমহাদেশ। কাটাতার তুলে দেওয়ার কোনো দরকার নেই। যেভাবে সীমান্তে রক্ষীবাহিনী আছেন তারা থাকুন।

কিন্তু মানবতা বজায় থাকুক অন্তত কেউ কাউকে বিদ্রুপ না করি, সীমান্ত হত্যা না হোক সবাই সবার দেশের পতাকাকে সম্মান করি। প্রতিবেশী হিসেবে শান্তিতে বাস করি। এই চাওয়াটা পৃথিবীর সব শান্তিপ্রিয় মানুষের। আগে মনে করতাম বুঝি পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষ শান্তিপ্রিয়। এখন কেন জানি মন বলে শান্তিপ্রিয় মানুষেরাই পৃথিবীতে সংখ্যালঘু। আমরা যে শান্তি চাই তা একপাক্ষিক কখনোই সম্ভব না একদল উসকানি দেবে আরেকদল নিরপেক্ষ থেকেই যাবে এটা সম্ভব না। কে উসকানি দেয় সে প্রসঙ্গ আনছি না। ওই প্রসঙ্গ তুললেই নতুন করে দাঙ্গার আশঙ্কা শান্তিপূর্ণ লেখাটাও বাগবিত-ে পরিণত হবে। আমি শুধু বলতে চাই যা হয়েছে ইতি টানুন এই হিংসার, এই বিদ্বেষের রাজনীতির।

সব যুদ্ধের শেষেই কিন্তু শান্তিচুক্তি হয়। আসুন আমরা এই হিংসা বিদ্বেষের মানসিক যুদ্ধের সমাপ্তি আনি একসঙ্গে বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, জ্ঞানচর্চা করে নিজেদের উন্নত করি। আমরা সেদিনই প্রকৃত অর্থে ম্যাচিউর হব যেদিন বুঝব প্রতিবেশীদের মধ্যে বিদ্বেষের বদলে শান্তি থাকলেই উন্নতি সম্ভব। ভাবুন যদি বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে, তবে এশিয়া মহাদেশ তথা বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তিতে পরিণত হবে এই তিনটি দেশ। প্রেমেই শান্তি, যুদ্ধে নয়। পরিবর্তনই সংসারের নিয়ম। তো চলুন আমরা পরিবর্তন আনি। হিংসা বিদ্বেষমূলক মনোভাব ত্যাগ করে প্রেম, সহানুভূতির মনোভাব ধারণ করি। আসুন প্রকৃত অর্থে আমরা সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ হয়ে উঠি।