ঢাকা বুধবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২৫

টিকটকের ফাঁদে তরুণ সমাজ

মিসবাহ উদ্দিন, বিয়ানীবাজার (সিলেট)
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৫, ২০২৫, ০২:২৪ এএম
  • বিয়ানীবাজারে টিকটক ও রিলস ভিডিওর আসক্তি উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে
  • ক্লাস ফাঁকি, পড়াশোনায় অনাগ্রহ ও বিদ্যালয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে
  • বিশেষজ্ঞদের মতে, পারিবারিক নজরদারি ও কাউন্সেলিং ছাড়া সমাধান সম্ভব নয়

প্রযুক্তির প্রসার ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতায় বাংলাদেশে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে টিকটক, ফেসবুক রিলস ও ইনস্টাগ্রাম ভিডিও তৈরির প্রবণতা এক নতুন সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। কিন্তু এই বিনোদন অনেক ক্ষেত্রেই পরিণত হয়েছে আসক্তিতে, যা এখন উদ্বেগজনক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছে সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলায়।

স্থানীয় শিক্ষক, অভিভাবক ও সমাজকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দিন দিন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভিডিও বানানোর অস্বাভাবিক ঝোঁক বাড়ছে। এর প্রভাবে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় আগ্রহ হারাচ্ছে, ক্লাস ফাঁকি দিচ্ছে এবং বিদ্যালয়ের নিয়ম-কানুন অমান্য করছে।

একটি স্থানীয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘শুধু টিকটক বানানো নয়, এর পেছনে সময়, পরিকল্পনা, পোশাক, মেকআপ, সবকিছুতেই শিক্ষার্থীরা এমনভাবে মগ্ন হয়ে পড়ে যে তারা ক্লাস ও পরীক্ষাও মিস করছে। মোবাইল নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও অনেকেই গোপনে ফোন নিয়ে আসে, ক্লাস চলাকালীন মাঠে বা বাথরুমে গিয়ে ভিডিও তোলে।’

শিক্ষকদের মতে, শুধু শিক্ষা নয়, এই ভিডিও আসক্তি প্রেমঘটিত দ্বন্দ্ব, মারামারি ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের ঘটনাও বাড়াচ্ছে।

বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও সমাজকর্মী মিলাদ জয়নুল ইসলাম বলেন, ‘অনেক ঘটনা অভিভাবক ও প্রতিষ্ঠানের মান-সম্মান রক্ষায় প্রকাশ পায় না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সচেতন নাগরিকদের প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে ভূমিকা রাখা জরুরি।’

অন্যদিকে, সচেতন মহল প্রশ্ন তুলছে, তরুণদের বিলাসী চলাফেরার অর্থ কোথা থেকে আসছে? কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, সামাজিক মাধ্যমের প্রভাব তরুণীদের বিপথগামীও করে তুলছে।

ঢাকা দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী এডভোকেট এইচ. এম. শাওওনুর রহমান উজ্জ্বল বলেন, ‘ভাইরাল হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে অনেক শিক্ষার্থী অনাকাঙ্ক্ষিত ও অশোভন কনটেন্ট তৈরি করছে। এটি ভবিষ্যতে তাদের শিক্ষা ও জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের সময় দেওয়া, ডিজিটাল ব্যবহারে নজর রাখা এবং স্কুলে সচেতনতামূলক কর্মশালা চালু করা।’

বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মাহফুজা খানম বলেন, ‘টিকটক ও রিলস তরুণদের বিনোদনের বড় মাধ্যম হয়ে উঠলেও এটি পড়াশোনা, মনোসংযোগ ও মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক মিলে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।’

আইনজীবী আক্তার হোসেন লিমন মনে করেন, ‘প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার শিক্ষার পরিপূরক হতে পারে। কিন্তু অপব্যবহার তরুণ প্রজন্মকে বিপথে নিচ্ছে। সময় ব্যবস্থাপনা শেখানো এখন সবচেয়ে জরুরি।’

বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজের আইসিটি বিভাগের প্রভাষক বিজিত আচার্য্য বলেন, ‘যে সময় শিক্ষার্থীরা টিকটকে ব্যয় করছে, সেই সময় যদি বই বা ই-বুক পড়ায় ব্যয় করত, তাদের ফলাফল ও জ্ঞান উভয়ই উন্নত হতো। এই আসক্তি মানসিক বিকার, পারিবারিক অশান্তি ও সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট করছে, যা ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত।’

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংকট থেকে উত্তরণে পরিবার, বিদ্যালয়, সমাজ ও সরকার, সবার সমন্বিত উদ্যোগই হতে পারে একমাত্র পথ।