জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ বাস্তবায়নের সুপারিশ বাংলাদেশের রাষ্ট্রসংস্কারের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচনা করতে যাচ্ছে। কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, এই সনদ বাস্তবায়নের জন্য অবিলম্বে একটি সাংবিধানিক আদেশ জারি করে গণভোট আয়োজনের আহ্বান জানানো হয়েছে। এর মাধ্যমে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কারের পথ উন্মুক্ত হবে, যা স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন ধরে বহু আকাক্সিক্ষত এক গণতান্ত্রিক পদক্ষেপ।
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রায় এক বছরের আলোচনা, মতবিনিময় ও রাজনৈতিক পর্যালোচনার পর যে প্রস্তাবনা দিয়েছে, তাতে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর গভীর পরিবর্তনের ইঙ্গিত রয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করে কমিশন ৬৪টি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। বলা যায়, এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে সমঝোতার এক বিরল দৃষ্টান্ত।
কমিশনের প্রস্তাবিত তিনধাপের বাস্তবায়ন পদ্ধতি, প্রথমে সাংবিধানিক আদেশ, তারপর গণভোট, এবং শেষে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন, দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার এক সাহসী প্রয়াস। এটি কেবল একটি প্রশাসনিক বা আইনি প্রক্রিয়া নয়, বরং জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক ঐতিহাসিক রূপান্তর।
অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজের বক্তব্যে যে বিষয়টি বিশেষভাবে উঠে এসেছে, তা হলো জনগণের প্রতি আস্থা। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধ করেছে, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়েছে, তারা বুঝতে পারে, তারা সিদ্ধান্ত নিতে জানে।’ এই বক্তব্যে নিহিত আছে গণতন্ত্রের মূল দর্শন, যেখানে জনগণই রাষ্ট্রের মালিক, তাদের হাতে থাকা উচিত চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের ক্ষমতা।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসও এই প্রক্রিয়াকে ‘রাষ্ট্রসংস্কারের নতুন অধ্যায়’ হিসেবে দেখেছেন। তিনি বলেছেন, ‘কমিশন আমাদের হাতে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের যে কাঠামো তুলে দিচ্ছে, সেটি যদি আমরা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারি এবং কাজ এগিয়ে নিতে পারি, তাহলে বাংলাদেশ অতীতের বোঝা থেকে মুক্তি পাবে। আমরা চাই নতুনভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে। এই সনদ সেই পথ দেখাবে।’ তার এই বক্তব্যে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন যে কেবল রাজনৈতিক সংস্কার নয়, এটি ন্যায্যতা, জবাবদিহি ও জনগণকেন্দ্রিক প্রশাসনিক পুনর্গঠনের অগ্রযাত্রা তার প্রমাণ পাওয়া যায়। তার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা ও দুর্নীতিবিরোধী কাঠামোতে সংস্কারের যে ধারাবাহিকতা শুরু করেছে, এই গণভোটের মধ্যদিয়ে তা সাংবিধানিক ভিত্তি পেতে পারে বলাই যায়।
গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কারের প্রশ্নে অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করলেও, কমিশন সেই শঙ্কাকে গণতান্ত্রিক আস্থার আলোয় মোকাবিলা করেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গণভোটের নজির টেনে তারা যুক্তি দিয়েছে, একাধিক বিষয় একটি প্রশ্নে রাখা অস্বাভাবিক নয়; বরং এটি জনগণের সামষ্টিক মতের প্রতিফলন। জনগণের ওপর আস্থা রাখার এই আহ্বানই আসলে জুলাই সনদের মূল চেতনা।
জুলাই সনদের অধীনে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব, যেমন উপজেলা পর্যায়ে আদালত সম্প্রসারণ, বিচারব্যবস্থা ডিজিটালাইজেশন, দুর্নীতিবিরোধী কৌশলপত্র প্রণয়ন, বা নতুন প্রশাসনিক বিভাগ গঠন, এসব উদ্যোগ রাষ্ট্রকে আরও বিকেন্দ্রীভূত, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করে তুলবে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই সনদের গুরুত্ব অপরিসীম। দীর্ঘদিন ধরে দলীয় রাজনীতির সংঘাত, অবিশ্বাস ও স্বজনপ্রীতির রাজনীতি গণতন্ত্রকে ক্ষয় করেছে। এখন সময় এসেছে জনগণের হাতে রাষ্ট্রসংস্কারের নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে দেওয়ার। এই গণভোট সেই সুযোগ এনে দিতে পারে, যদি সরকার দ্রুত প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক আদেশ জারি করে এবং একটি স্বাধীন, স্বচ্ছ গণভোট আয়োজন নিশ্চিত করে।
বাংলাদেশ এখন এক ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে, জুলাই সনদের নির্দেশনা মেনে, যদি আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে এগোতে পারি, তবে ন্যায়, সমতা ও মানবিকতার যে বাংলাদেশ আমরা কল্পনা করি, তা বাস্তবায়ন করা অসম্ভব নয়।
জুলাই সনদ তাই কেবল একটি দলিল নয়, এটি নতুন বাংলাদেশের সূচনাপত্র। এই সনদের পথ ধরেই অগ্রসর হোক আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ, দৃঢ় পদক্ষেপে, স্বপ্নময় ভবিষ্যতের দিকে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন