বুধবার, ১৯ নভেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মল্লিক মাকসুদ আহমেদ বায়েজীদ, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৯, ২০২৫, ০১:৪৩ এএম

হাসিনা-কামালের মৃত্যুদণ্ডের রায় : রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ দায়বদ্ধতা ও ন্যায়বিচারের কঠোর বার্তা

মল্লিক মাকসুদ আহমেদ বায়েজীদ, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৯, ২০২৫, ০১:৪৩ এএম

হাসিনা-কামালের মৃত্যুদণ্ডের রায় : রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ দায়বদ্ধতা ও ন্যায়বিচারের কঠোর বার্তা

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর রায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মানবতাবিরোধী অপরাধ-মামলায় মৃত্যুদ- দেওয়া হয়েছে। এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও আইনি ইতিহাসে এক অতুলনীয় মাইলফলক, যা কেবল ব্যক্তিগত বিচার নয়; রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, দায়বদ্ধতা এবং ভবিষ্যতের রাজনীতিতে এক পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। বিশেষত যখন রায়ের অভিযোগের মুখে আছে ২০১৩ সালের হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে সংঘটিত হত্যাকা-, তখন এর প্রতীকী এবং প্রায়োগিক গুরুত্ব আরও গুরুভারী হয়ে ওঠে। আইনজীবীরা বলছেন, হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা বিভিন্ন মামলাগুলোর মধ্যে এটিই প্রথম রায়Ñ যা একদিকে পুরোনো রাজনৈতিক ইতিহাসকে আবার জাতিগত বিচারক্ষেত্রে নিয়ে এসেছে, অন্যদিকে ভবিষ্যতের জন্য নতুন রাজনীতির মাপকাঠি সৃষ্টি করছে।

প্রথমত, এ রায় দেয় এক স্পষ্ট বার্তা যে ক্ষমতার চূড়াতে থাকা ব্যক্তি ও আইনের দায়দায়িত্ব থেকে মুক্ত নয়। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাজনৈতিক নেতাÑ কর্তৃত্ব এমন একটি ধারণায় আবদ্ধ ছিল যে ক্ষমতা মানেই কোনোক্রমেই দায়মুক্তি। কিন্তু এই রায় দেখায় যে আইনশাসন ও আন্তর্জাতিক বিচার প্রক্রিয়া তখনই কার্যকর, যখন তা ক্ষমতার ঠিক ওপারে দাঁড়ায়। শেখ হাসিনা ও কামালের মতো উচ্চ ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা যদি তদন্ত ও বিচারের মুখোমুখি হতে পারে, তাহলে ভবিষ্যতে অন্য নেতাদের জন্য একটি শক্তিশালী সতর্কবাণী তৈরি হবে : তাদের সিদ্ধান্ত, নির্দেশনা এবং আদেশ শুধু রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, আইনগত মূল্যায়নেরও আওতায় থাকবে।

দ্বিতীয়ত, যেসব ঘটনা এ মামলায় হাইলাইট করা হয়েছে, সেগুলো রাষ্ট্রীয় ইতিহাসে দীর্ঘকাল ব্রণের মতো থেকে যায়। বিশেষ করে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে গুলিবর্ষণ এবং প্রাণহানির ঘটনাÑ যা জাতীয় স্মৃতিতে এখনো ব্যথার প্রতিধ্বনিস্বরূপ এ রায় সেই পুরাতন জবাবদিহির খাতা আবার খুলে দিয়েছে। দীর্ঘকাল ধরে নিহত পরিবাররা তাদের ক্ষতি এবং ত্যাগের স্বীকৃতি চেয়েছে। তাদের দাবি ছিল যে তারা ইতিহাসে ভুলভাবে উপেক্ষিত। এ রায় তাদের স্বীকৃতি দেয়, তাদের যন্ত্রণার সত্যতা আইনের মঞ্চে প্রতিষ্ঠিত করে এবং তাদের কণ্ঠকে আন্তর্জাতিক বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে গৃহীত প্রতিক্রিয়া এনে দেয়। এটি শুধু প্রতিশোধ নয়; এটি এক ন্যায়িক এবং মানবিক পুনরুজ্জীবন প্রক্রিয়া, যা ভবিষ্যতে সামাজিক পুনর্মিলন ও সহাবস্থানের পথকে প্রসারিত করতে পারে।

তৃতীয়ত, বিচার ব্যবস্থার পুনরায় আস্থার ভিত্তি তৈরি করার একটি অভূতপূর্ব সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিচারপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এবং আইনের শাসনই যে সত্যিকারের শক্তি, এ রায় তা প্রমাণ করে। অনেকেই আইন ও বিচার ব্যবস্থার রাজনৈতিক পক্ষপাত, ক্ষমতাসীন দায়বিহীনতা এবং প্রমাণহীন সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন। কিন্তু এখন, একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল শীর্ষ নেতৃত্বকে দায়ে দায়ে দায়বদ্ধ করেছেÑ যা দেখায় যে বিচারক্ষেত্রে প্রমাণের গুরুত্ব অপরিহার্য এবং আইন সব রাজনৈতিক শ্রেণির জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। এ ধরনের রায় জনসাধারণের আদালতে বিশ্বাস পুনর্গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে, এবং ভবিষ্যতে আদালতকে একটি গণতান্ত্রিক গুরুত্ববোধের মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।

চতুর্থত, এ রায় রাজনৈতিক সংস্কারের সূচনা করতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের রাজনীতি ছিল অনিয়ম, প্রতিশোধ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের রাজত্ব। নেতারা প্রায়শই নিজেদের সিদ্ধান্তের জন্য দায়বদ্ধ ছিলেন না। তবে এখন, এ রায় একটি নতুন নীতিমালা স্থাপন করে বরাতে দেয় যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব যা করেছেন, তা বিচারপ্রক্রিয়া ও দায়বদ্ধতার আলোকে মূল্যায়িত হবে। এটি একটি নতুন যুগের সূচনা হতে পারে, যেখানে রাজনৈতিক গণতন্ত্র কেবল ভোটের ওপর ভিত্তি করবে না; বরং ন্যায়বিচার, স্বচ্ছতা ও মানুষের মানবাধিকার সম্মানিত হওয়ার একটি কাঠামো গড়বে। ভবিষ্যতের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে শুধু জনপ্রিয়তা বা ক্ষমতা মানেই বড় মাপদ- হিসেবে বিবেচনা করা হবে নাÑ তাদের কর্তৃত্ব, সিদ্ধান্তগ্রহণ ও প্রশাসনিক নির্দেশনাও বিচার ও দায়বদ্ধতার আলোকে পরিমাপিত হবে।

পঞ্চমত, প্রশাসন এবং নিরাপত্তা বাহিনীর দৃষ্টি ও দায়িত্বক্ষেত্রও এ রায়ের পর পরিবর্তন পেতে পারে। গত কয়েক দশক ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে ‘ঊর্ধ্বতন নির্দেশ’ নামে এমন একটি সংস্কৃতি গড়ে ওঠে যেটি মাঝে মধ্যে গোপন অপারেশন এবং অবৈধ ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়। তবে এ রায় স্পষ্ট করে দেয় যে, রাজনৈতিক আদেশ বা নির্দেশিকা আইন মান্য করার অজুহাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনকে বৈধতা দেবে না। ভবিষ্যতে বাহিনীর কর্মকর্তারা আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগ করার সময় আরও নৈতিক ও আইনভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে বাধ্য হতে পারে, যা মানুষের মৌলিক অধিকারকে রক্ষা করবে এবং অপব্যবহারের সম্ভাবনা কমাবে।

ষষ্ঠত, এ রায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকা ও মর্যাদা নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারে। একটি দেশের জন্য, বিশেষ করে একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য, এমন বিচারপ্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে তা দেখায় সে মানবতাবিরোধী অপরাধ মোকাবিলা করতে প্রস্তুত এবং আইন ও মানবাধিকারের মানদ-কে সম্মান করে। হেফাজতের মতো বিতর্কিত এবং ইতিহাস-ভারী ঘটনাকে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার করা হলে, এটি বাংলাদেশের আইনি স্বনির্ভরতা ও পরোপকারী ক্ষমতাকে একটি গ্লোবাল মঞ্চে প্রতিষ্ঠিত করবে। এতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এবং আইনগত গোষ্ঠীদের সঙ্গে ভবিষ্যৎ সহযোগিতার সুযোগও বাড়তে পারে, কারণ তারা দেখবে যে বাংলাদেশ শুধু প্রতিশোধাত্মক রাজনীতি করছে না, বরং দৃঢ় আইনশাসন ও দায়বদ্ধতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে।

সপ্তমত, এ রায় সামাজিক সমন্বয় ও পুনর্মিলনের ক্ষেত্রে এক ইতিবাচক উপাদান হিসেবে কাজ করতে পারে। বিচার কেবল শাস্তি দিনা মাঝেই সীমাবদ্ধ না হয়ে জনসাধারণের মধ্যে মেরামত এবং সংহতির প্রসার ঘটাতে পারে। যেসব পরিবার তাদের স্বজন হারিয়েছে, তাদের ক্ষত এখনো সারেনি; তাদের জন্য শুধু শাস্তি নয়, সত্য এবং মর্যাদাপূর্ণ পুনরুদ্ধার প্রয়োজন। এ রায় তাদেরকে একটি মানসিক এবং আইনগত প্রতিকার দিচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক পুনর্মিলনের পথ সুগম করতে পারে।

তবে, এ রায়ের সঙ্গেই বিপুল দায় ও চ্যালেঞ্জও আসে। কিছু মানুষের চোখে এটি রাজনৈতিক প্রতিশোধের ছলনা হিসেবে প্রতীয়মান হবে। তারা বলবেন, বিচার নিয়ন্ত্রিত হয়েছে, এবং এটি এক পক্ষব্যক্তিগত আক্রমণ মাত্র। যদি এমন ধারণা জনসাধারণের মধ্যে প্রবল হয়, তাহলে আইনপ্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈধতা ও বিচারশাস্ত্রের গ্রহণযোগ্যতা ক্ষুণœ হতে পারে। তাই রায় ঘোষণার পর প্রশাসন, বিচারক ও আইনজীবীদের জন্যে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় যে তারা প্রক্রিয়াটির স্বচ্ছতা বজায় রাখে, প্রমাণ ও যুক্তির ব্যাখ্যা খোলামেলা করে এবং জনগণের মধ্যে আস্থার পুনর্নির্মাণে কাজ করে।

মোদ্দা কথা, হাসিনা-কামালের মৃত্যুদ-ের রায় একটি নির্মম কিন্তু অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সতর্কবার্তা দেয়: ক্ষমতা অনির্ধারিত নয়; দায়বদ্ধতা চিরস্থায়ী। হেফাজতের সমাবেশের ভয়ংকর ইতিহাস, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মানবিক পরিণতি এবং ক্ষমতার উত্তরদায়িত্বÑ এ সবকিছুকে একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে টেনে ধরেছেন আদালত। যদি এ রায় ন্যায্যতা, স্বচ্ছতা এবং প্রমাণভিত্তিকতার মাপকাঠিতে প্রয়োগ করা হয়, তাহলে এটি ভবিষ্যতের জন্য এক শক্তিশালী দৃষ্টান্ত গঠন করতে পারে, যেখানে রাজনীতি এবং প্রশাসন কেবল ক্ষমতার লড়াই নয়, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রতীক হয়ে দাঁড়াবে।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!