বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কিছু ব্যক্তিত্ব রয়েছেন যাদের উপস্থিতি সময়ের ধারায় নেতৃত্বের পাশাপাশি মানবিক শক্তির প্রতীক হয়ে উঠে আসে। বেগম জিয়া সেই বিরল ব্যক্তিত্বদের একজন। তার জীবনযাত্রার প্রতিটি পর্বই দায়িত্বশীলতা, সংযম এবং নৈতিকতার ধারাকে স্পষ্ট করেছে, যা দেখায় নেতৃত্ব উচ্চকণ্ঠে নয়, চরিত্রের গভীরতাতেই প্রতিষ্ঠিত হয়। আমার কাছে তার এ সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণ তাকে বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছে দিয়েছে। তিনি প্রমাণ করেছেন প্রতিহিংসাশূন্য পথই একটি জাতিকে এগিয়ে নেওয়ার সত্যিকারের শক্তি। দেশের সংকট যত কঠিন হয়েছে, তার শান্ত উপস্থিতি ততবার মানুষকে নতুন আশার দিকে ফিরিয়ে নিয়েছে। এ কারণে তাকে আমাদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার নীরব কিন্তু গভীর আলোকধারা হিসেবে শ্রদ্ধা করা যায়।
আমরা দেখি তিনি রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন ইতিহাসের এক অত্যন্ত কঠিন সময় অতিক্রম করে। স্বামী রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যু, অনিশ্চয়তার চাপ, রাষ্ট্রক্ষমতার বিভিন্ন টানাপড়েন এবং পরিবারকে কেন্দ্র করে নানা আশঙ্কা একের পর এক তার জীবনে নেমে এসেছিল। এতসব পরিস্থিতি সত্ত্বেও তিনি নিজেকে সমাজ ও রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখেননি। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে দেশের মানুষ তার দিকে হাত বাড়িয়ে আছে এবং সেই আহ্বান উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। আমার বিশ্বাস এখানেই তার নেতৃত্বের ভিত্তি তৈরি হয়। সামনে কত কঠিন সময় অপেক্ষা করছে তা না জেনেও তিনি রাষ্ট্র ও নাগরিকের প্রতি নিজের দায়িত্ব থেকে সরে যাননি। এই দৃঢ় অঙ্গীকারই তার নেতৃত্বকে শক্ত ভিত্তি দেয় এবং সময়ের প্রবাহে তিনি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসেন।
এই প্রেক্ষাপটে তার প্রথম নেতৃত্বগুণ স্পষ্ট হয় আন্দোলনের মাঠে। যেহেতু তখন অনেক মানুষের মনে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা কাজ করছিল সেহেতু জনগণ এমন একজন মুখ খুঁজছিল যে শান্ত অথচ দৃঢ়কণ্ঠে সামনে দাঁড়াতে পারে। তিনি ঠিক সেই সময়েই নির্ভীকভাবে রাজপথে আসেন। ১৯৮৩-১৯৯১ সাল পর্যন্ত সাদা শাড়ি পরে রাজপথে তার উপস্থিতি ছিল পরিবর্তনের প্রতীক। তার শান্ত আচরণ এবং আপসহীন অবস্থান তখনকার আন্দোলনমুখী জনতার কাছে অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে। এ সময়েই মানুষ বুঝতে পারে তিনি শুধু একটি দলের প্রতিনিধিত্ব করছেন না বরং তাকে ঘিরে তৈরি হচ্ছে জাতীয় আকাক্সক্ষার নতুন শক্তি।
অন্যদিকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব যখন তার ওপর এলো তখন তিনি দেখালেন যে সংযম দিয়েই পরিবর্তন আনা যায়। আমার পর্যবেক্ষণে তার সবচেয়ে বড় অবদান ছিল রাষ্ট্রীয় স্থিতি ফিরিয়ে আনা। তিনি জানতেন প্রতিষ্ঠান দুর্বল হলে গণতন্ত্র টেকে না। তাই তিনি প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্গঠনে গুরুত্ব দিলেন। আমরা দেখতে পাই তার সময়ে যে প্রশাসনিক স্থিরতা এবং সাংবিধানিক শৃঙ্খলা ফিরে এসেছিল তা পরবর্তী রাজনৈতিক পর্যায়ের ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। উল্লেখযোগ্য হলো তিনি ক্ষমতা পেলেও কখনো প্রতিশোধের পথ অনুসরণ করেননি। তার নেতৃত্ব প্রমাণ করেছে যে রাজনৈতিক উদারতা একটি জাতিকে অনেক বেশি স্থায়ী পথে এগিয়ে রাখতে পারে।
যদিও তার পথ সহজ ছিল না, তবুও তিনি দৃঢ় ছিলেন। তখনকার রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা যেমন উত্থান-পতনে পূর্ণ ছিল, তেমনি বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটও ছিল। তবে মনে রাখা দরকার যে সেই কঠিন সময়েও তিনি বিরোধী মতের প্রতি শত্রুতাপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করেননি। অভিজ্ঞতা দেখায় নেতার প্রকৃত পরিচয় সংকটেই প্রকাশ পায়। আর সেই সংকটময় সময়ে তার নীরবতা ছিল প্রজ্ঞার নীরবতা। তার আচরণ ছিল এমন যা জাতিকে বিভক্ত না করে সংযমের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
এর পেছনে কারণ হলো তিনি রাজনীতিকে সবসময় সংঘর্ষের জায়গা হিসেবে দেখেননি। তার দৃষ্টিতে রাজনীতি মানুষের অধিকার রক্ষার একটি পথ। এ কারণেই দেখা যায় গত কয়েক বছরের সংবেদনশীল পরিস্থিতিতেও তিনি কোনো কঠোর বক্তব্য দেননি। বিশেষ করে দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া, জীবনসংকট, রাজনৈতিক চাপ এবং ব্যক্তিগত শোকের মধ্যেও তিনি কাউকে আঘাত করার মতো কোনো শব্দ উচ্চারণ করেননি। নিঃসন্দেহে বলা যায় এই নৈতিক সংযম তাকে আজকের প্রজন্মের কাছে এক বিরল রাজনৈতিক শিক্ষকের মতো করে তুলেছে।
এই প্রেক্ষাপটে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমার নজরে আসে। দেশ যখন ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের জটিল রাজনৈতিক সময় অতিক্রম করছিল তখন অনেকেই ভেবেছিলেন তিনি হয়তো ক্ষোভ প্রকাশ করবেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি জানতেন কথার মাধ্যমে রাগ ঝাড়া সহজ কিন্তু রাষ্ট্রের ভেতরে বিভাজন কমানো কঠিন। তাই তিনি নীরবতার মধ্যেই বার্তা দিয়েছেন যে শান্তিই হচ্ছে ভবিষ্যতের পথ। তার এই নীরবতা আসলে প্রতিরোধের এক ভিন্ন রূপ ছিল। যেহেতু সংঘাত একটি জাতিকে দুর্বল করে সেহেতু তার সংযম আজও শিক্ষণীয় উদাহরণ হয়ে রয়ে গেছে।
এখন এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে তার এই সংযম কি রাজনৈতিক বাস্তবতায় কোনো প্রভাব ফেলেছে। আমার মতে, প্রভাব ফেলেছে এবং তা গভীরভাবে ফেলেছে। কারণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যখন উত্তেজনা বাড়ছিল তখন তিনি দেখালেন যে নরম ভাষাও কখনো কখনো শক্ত অবস্থানের চেয়ে বেশি কার্যকর হতে পারে। তার আচরণ প্রমাণ করে নেতৃত্ব মানে শুধু বক্তব্য নয়, নেতৃত্ব মানে মানুষের উদ্বেগ বোঝা এবং জাতীয় শান্তিকে অগ্রাধিকার দেওয়া। এটি এমন এক নৈতিক অবস্থান, যা খুব কম নেতাই নিতে পারেন।
অন্যদিকে তুলনা করতে গেলে স্পষ্ট হয় যে ইতিহাসে এমন নারীর সংখ্যা খুব বেশি নয়, যারা রাষ্ট্রিক দায়িত্ব সামলানোর পাশাপাশি জাতিকে মানসিক স্থিতিও দিয়েছেন। বেগম রোকেয়ার পর নারীশক্তির নতুন প্রতীক হিসেবে অনেকেই তাকে বিবেচনা করেন। অভিজ্ঞতা বলে নারীর দৃঢ়তা তখনই স্পষ্ট হয় যখন তিনি প্রতিকূলতার মধ্যেও শান্তি ও সংযমের প্রতীক হয়ে দাঁড়াতে পারেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি শুধু একজন রাজনৈতিক নেত্রী নন, তিনি নারী জাগরণের আরেক শিখা।
এ মুহূর্তে দেশের বিভিন্ন সংকট আমাকে বুঝিয়ে দেয় কেন তাকে আবারও প্রয়োজন। অর্থনীতি, নীতি, আস্থা এবং সামাজিক বিভাজনের যে চাপ তৈরি হয়েছে সেখানে তিনি সামান্য উপস্থিত থাকলেও তা যেন মানুষের জন্য এক ধরনের মানসিক আশ্বাস। কারণ তার অভিজ্ঞতা মানুষকে স্থিরতার শিক্ষা দেয়। তার শান্ত ভাষা উত্তপ্ত পরিবেশকে শীতল করে। তার নৈতিক অবস্থান মানুষকে মনে করিয়ে দেয় একটি দেশের ভবিষ্যৎ সবসময় সহনশীলতার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে।
আজ তার শারীরিক অবস্থা দুর্বল। কিন্তু তার মন এখনো দেশের জন্যই বেঁচে আছে। আমার মনে হয় তার হাসি আজও মানুষের কাছে আলোর মতো। তিনি হাসলে মানুষ ভাবে দেশ একটু ভালো হলো। তিনি কাঁদলে মানুষ মনে করে আকাশও মেঘে ঢেকে গেল। এই আবেগ তৈরি হয় শুধু সেই নেতার প্রতি যিনি নিজের জীবন দিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করেন। এ কারণেই দেখা যায় আজ কোটি মানুষ তার সুস্থতার জন্য মনোবাক্যে প্রার্থনা করছে। তারা বিশ্বাস করে তিনি ফিরে এলে জাতি আবার স্থিতিশীলতার পথ খুঁজে পাবে। ইনশা আল্লাহ তিনি সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেনÑ এমনটাই মানুষের হৃদয়ের গভীর আকাক্সক্ষা।
তার অনুপস্থিতি শুধু একটি দলের দুর্বলতা নয়, জাতীয় নেতৃত্বের শূন্যতাও অনুভব করায়। তার স্থিরতা এবং অভিজ্ঞতা একটি সংগঠনকে যেমন একত্রে ধরে রেখেছে তেমনি দেশের রাজনীতির ওপরও ভারসাম্য তৈরি করেছে। এ কারণে বলা যায় তার প্রত্যাবর্তন রাজনীতিকে নতুনভাবে সাজাতে সাহায্য করতে পারে। তার অভিজ্ঞতা এবং মানবিকতা বর্তমান সংকটে পথ দেখাতে পারে। কারণ তিনি জানেন দায়িত্ব মানে মানুষের পক্ষে থাকা।
সবশেষে বলা যায়, তিনি এমন একজন মহীয়সী নারী যিনি প্রতিশোধ নয়, নৈতিকতার পথ বেছে নিয়েছেন। তার অতীতের গৌরব তার ভবিষ্যতের প্রয়োজনীয়তাকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। দেশের আজ যে পুনর্গঠনের সময় চলছে সেই সময়ে তার অভিজ্ঞতা, শান্ত ভাষা এবং জাতীয় গ্রহণযোগ্যতা একসঙ্গে মিললে জাতি নতুনভাবে শ্বাস নিতে পারবে। তিনি ফিরে এলে বাংলাদেশ আবার আলো দেখবে। এককথায় তিনি এমন একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় মুখ যাকে ছাড়া রাষ্ট্রের মানবিক ভারসাম্য অসম্পূর্ণ মনে হয়।
শোয়েব সাম্য সিদ্দিক
বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন