*** কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত
*** বিচের সৌন্দর্য ও পরিবেশ রক্ষায় মাঠপর্যায়ে নেই তদারকি
*** সৈকতের প্রধান তিন পয়েন্টে হাজারো অস্থায়ী দোকান
*** সৈকতে অরিরিক্ত বিশ্রামের চেয়ারের কারণে লাইন ধরে সমুদ্রে নামতে হয় পর্যটকদের
*** ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও সৈকতের আশপাশে নির্মিত হচ্ছে বহু স্থাপনা
বিশে^র দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার। অথচ এই আন্তর্জাতিক মানের পর্যটনকেন্দ্র আজ নানামুখী অব্যবস্থাপনা, দখল ও বিশৃঙ্খলার চাপে তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারাতে বসেছে। পর্যটকদের অভিযোগ, বিচের সৌন্দর্য ও পরিবেশ রক্ষায় যে পরিকল্পনা ও তদারক প্রয়োজন ছিল, মাঠপর্যায়ে তার প্রতিফলন নেই। বরং সব কিছুতেই দেখা যাচ্ছে বিশৃঙ্খলা এবং এলোমেলো অবস্থা। তবে জেলা প্রশাসক বলছেন, পর্যটকদের নিরাপত্তা, স্বাচ্ছন্দ্য এবং একটি পরিচ্ছন্ন সুন্দর সৈকত নিশ্চিত করতে কাজ করা হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, সৈকতের লাবনী, সুগন্ধা ও কলাতলী, এই তিন প্রধান পয়েন্টে দেখা গেছে হাজারো অস্থায়ী দোকান। টি-স্টল, আচার বিক্রেতা, শামুক-ঝিনুক ও খেলনার দোকানসহ এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে আছে ঝুপড়িঘর। পর্যটন এলাকার সৌন্দর্য বর্ধনে বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির অনুমোদিত ডিজাইনে দোকানগুলোর গঠন ও রঙ-রূপ এক করার কথা ছিল। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডিজাইন দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে পর্যটন অঞ্চল এলোমেলো হয়ে থাকছে বছরের পর বছর।
সৈকতে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো কিটকিট ছাতা-চেয়ার বসালেও তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে। একটি চেয়ারের সঙ্গে আরেকটি এমনভাবে লাগানো থাকে যে রাতে তো বটেই, দিনের বেলাতেও সৈকতে স্বাচ্ছন্দ্যে হেঁটে চলা কষ্টকর হয়ে যায়।
পর্যটকদের অভিযোগ, সৈকতে নামতে গেলেই বাধা হয়ে দাঁড়ায় লম্বা লাইন। মনে হয় যেন চেয়ার জঙ্গল। এগুলোর অনুমতিপত্র জেলা প্রশাসন থেকে দেওয়া হলেও ম্যানেজমেন্টের দৃশ্যমান তদারকি নেই বলে অভিযোগ স্থানীয় হোটেল-মোটেল মালিকদের। তাদের মতে, সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া (ইসিএ) ঘোষিত বালিয়াড়ি অঞ্চল। পরিবেশগত ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও সেখানে নির্মিত হচ্ছে বহু কংক্রিট স্থাপনা।
স্থানীয় পরিবেশ পর্যবেক্ষকদের মতে, বালিয়াড়ি দখলের এ প্রবণতা চলতে থাকলে সৈকতের প্রাকৃতিক বালুকাবেলা দ্রুত ক্ষয়ে যাবে। ইসিএ এলাকায় যে কোনো স্থাপনা সংরক্ষণ আইনের পরিপন্থি। কিন্তু পর্যাপ্ত নজরদারি না থাকায় দখলদাররা বালিয়াড়ির বুক চিরে দোকানপাট, আবাসন, রিসোর্ট, সবই গড়ে তুলছে।
সৈকতের লাবনী, সুগন্ধা ও কলাতলী, এসব পয়েন্টে প্রতিদিন হাজারো পর্যটক আসেন। কিন্তু অঞ্চলজুড়ে নেই পর্যাপ্ত ডাস্টবিন। বর্জ্য সংগ্রহ বা নিয়মিত পরিষ্কারের কার্যকর ব্যবস্থা না থাকায় বোতল, পলিথিন, খাবারের প্যাকেট, সবই জমে থাকে বালুর ওপর।
পরিবেশকর্মী অশোক কুমার বড়ুয়াসহ অনেকে বলছেন, বিশে^র দীর্ঘতম সৈকতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই বললেই চলে, এটা একটি বিশাল ব্যর্থতা। সৈকতে জেলা প্রশাসনের অনুমতিপত্র নিয়েই সবকিছু হয়, কিন্তু নেই বাস্তব তদারকি। সৈকতের এই অগোছালো চিত্রের মূল কেন্দ্রে রয়েছে অনুমতিপত্র ব্যবস্থাপনা। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া হয় দোকান ও কিটকিট চেয়ার-ছাতাসহ সব ব্যবসায়ীর কার্ড। কিন্তু তা দেওয়ার পরে স্থাপনার নকশা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, জায়গা দখল, কোনো কিছুরই পর্যবেক্ষণ নেই নিয়মিত।
স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের মতে, সৈকত ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত নীতিমালা না থাকায় প্রতিদিনই বাড়ছে বিশৃঙ্খলা। কক্সবাজারে আগত পর্যটকদের প্রত্যাশা, সৌন্দর্য ফিরে পাক বিশে^র সবচেয়ে দীর্ঘতম বালিয়াড়ির সৈকত।
পর্যটকরা বলছেন, সৈকতকে যদি সাজানো-গোছানো করা হয়, তবে কক্সবাজারের পর্যটন আয় আরও বহুগুণ বাড়বে। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের দাবি, কক্সবাজারের সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে জরুরিভিত্তিতে সমুদ্রসৈকত জোনে মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন, ব্যবসায়ীদের জন্য একই ডিজাইনের স্থাপনা, স্টল পুনর্বিন্যাস, ইসিএ এলাকায় দখল উচ্ছেদ এবং সৈকতজুড়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা জোরদার করা।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. আবদুল মান্নান জানিয়েছেন, বিশে^র দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনায় জেলা প্রশাসন কঠোর অবস্থানে আছে। যত্রতত্র স্থাপনা, কিটকিট চেয়ার ও পরিবেশগত ঝুঁকিপূর্ণ কোনো কার্যক্রম বরদাশত করা হবে না। বালিয়াড়ি এলাকায় অবৈধ স্থাপনা অপসারণ এবং সৈকত এলাকায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা জোরদারেও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে ইতোমধ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পর্যটকদের জন্য একটি নিরাপদ, সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন সৈকত নিশ্চিত করতেই আমাদের সব উদ্যোগ।
তিনি বলেন, সৈকতের স্বকীয়তা ও পরিবেশ রক্ষায় প্রশাসন কঠোর অবস্থানে আছে। পর্যটকদের নিরাপত্তা, স্বাচ্ছন্দ্য এবং একটি পরিচ্ছন্ন সুন্দর সৈকত নিশ্চিত করতেই আমরা কাজ করছি। এ বিষয়ে কাউকে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক থেকে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত অনন্য। কিন্তু প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা, দখল ও পরিকল্পনাহীনতার কারণে এই সৌন্দর্য দ্রুত ম্লান হয়ে যাচ্ছে। এখনই যদি দায়িত্বশীল তদারকি ও দূরদর্শী পরিকল্পনা গ্রহণ না করা হয়, তবে বিশে^র দীর্ঘতম সৈকত তার স্বকীয়তা হারাবে চিরতরে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন