শীতকাল বলতেই অনেকের চোখে ভেসে ওঠে কুয়াশায় ঢাকা কোনো গ্রাম, খেলার মাঠের এক কোনায় একটু-আধটু রোদ। কারো হয়তো মনে পড়ে শৈশবের স্কুলের স্মৃতি। নানা কারণে শীতকাল আমাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। ঢাকা কিংবা দেশের দক্ষিণাঞ্চলে শীতের উপস্থিতি তুলনামূলক হালকা হলেও উত্তরবঙ্গে কিন্তু এরইমধ্যে শীত নেমেছে পুরোপুরি। রাজধানীতে শীত দীর্ঘস্থায়ী নয়; ঠান্ডা আসে অনেক দেড়িতে, আবার ক’দিন ঠান্ডার পরই শীতকাল শেষ হয়ে যায়। তাই শীতের আসল আমেজ অনুভব করতে চাইলে উত্তরবঙ্গ ভ্রমণ হতে পারে চমৎকার অভিজ্ঞতা। চলুন আপনাদের নিয়ে যাই পঞ্চগড়, দিনাজপুর এবং কুড়িগ্রাম জেলার পথে পথে; যেখানে দেখা মিলবে কুয়াশার স্নিগ্ধতা এবং গ্রামীণ জীবনের সহজ-সরল সৌন্দর্য।
পঞ্চগড়
বাংলাদেশের সবচেয়ে উত্তরের জেলা পঞ্চগড় যেন শীতের স্বর্গ। নভেম্বর থেকেই এখানে তাপমাত্রা দ্রুত কমতে থাকে। নভেম্বরের ভোরে চোখ মেললেই দেখা যায় চারপাশ দুধ-সাদা কুয়াশায় ঢেকে আছে, দূরের গাছগুলোও ঝাপসা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিঃশব্দে। পঞ্চগড় ঘুরতে গেলে প্রথমেই যে জায়গাটি চোখে পড়ে, তা হলো চা-বাগান। এই জেলার বেশিরভাগ অংশ জুড়ে রয়েছে সবুজ চা-বাগানের বিস্তৃতি। শীতের সকালে সেই চা-বাগানের মধ্য দিয়ে হাঁটলে আপনার মনে হবে বাতাসের মধ্যেও ঠান্ডা রেশ লেগে আছে। ও, আরেকটি কথা! পঞ্চগড়কে কিন্তু হিমালয় কন্যা নামে ডাকা হয়। কেন জানেন? বলছি-
পঞ্চগড় ভ্রমণের মূল আকর্ষণ হলো তেঁতুলিয়া। পরিষ্কার দিনে তেঁতুলিয়া দাঁড়িয়েই হিমালয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। শীতের শুরুতে অনেকসময় আকাশ পরিষ্কার থাকে, ফলে সকাল কিংবা বিকেলে দূরের শুভ্র পাহাড় দেখা মিললে ভ্রমণকারীদের আনন্দ যেন আরও বেড়ে যায়। তেঁতুলিয়ার ডাকবাংলো এলাকা, শিয়ালটোলা, বুড়াবুড়িসহ সব জায়গাতেই কুয়াশা আর ঠান্ডা বাতাসের উপস্থিতি স্পষ্ট। স্থানীয় চা-স্টলে বসে গরম চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কানচনজঙ্ঘা দেখার অভিজ্ঞতা এক শব্দে অনন্য।
দিনাজপুর
উত্তরবঙ্গে শীত উপভোগ করতে গেলে দিনাজপুরও অপরিহার্য একটি জায়গা। এই জেলা একদিকে যেমন প্রাচীন ঐতিহ্যের ভান্ডার, অন্যদিকে শীতের সময় প্রকৃতিও এখানে রং বদলে ফেলে। কান্তনগর মন্দির, রামসাগর জাতীয় উদ্যান কিংবা দিনাজপুরের বিশাল ধানের খেত; সবকিছুতেই শীতের ছোঁয়া থাকে। কান্তজিউ মন্দির ভ্রমণে সকালে গেলে দেখা যায়, মন্দিরের দেয়ালের পাথরের গায়ে জমে থাকা শিশির হালকা সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করছে। মন্দিরের কারুকাজ এমনিই মনোমুগ্ধকর, তার ওপর শীতের আবহ তা আরও রহস্যময় করে তোলে। আর রামসাগরে শীতের সকালে হাঁটতে গেলে মনে হবে যেন প্রকৃতির গভীরে ঢুকে পড়া হলো। এখানকার শান্ত, নির্জন আর কুয়াশায় মোড়া পরিবেশ একধরনের প্রশান্তি দেয়। দিনাজপুরের রাস্তাঘাট, গ্রামাঞ্চলের মানুষ আপনাকে ভিন্ন অভিজ্ঞতা দিবে। এখানে ভ্রমণ যে কারো মন জুড়ায়। শহরতলির হোটেল বা রিসোর্টে থেকেও কাছের দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখা যায়। যারা একটু নীরব প্রকৃতি খুঁজছেন, তাদের জন্য দিনাজপুর শীতকালে দারুণ উপযোগী।
কুড়িগ্রাম
কুড়িগ্রাম মানে নদী, চরের জীবন ও বিস্তীর্ণ ফাঁকা আকাশ। ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা হলো কুড়ীগ্রামের নদী। এখানকার নদীগুলো শীতে এক ধরনের শান্ত রূপ নেয়। প্রবল স্রোত আর বর্ষার উত্তালতা কমে গিয়ে নদী হয়ে ওঠে স্বচ্ছ ও স্থির। কুড়িগ্রামের এই নদীপাড় শীতকালে ভ্রমণকারীদের অন্য রকম আবেশে আচ্ছন্ন করে। কুড়িগ্রামের ধরলা ব্রিজ এখানকার একটি জনপ্রিয় পর্যটন স্থান। শীতকালের সকালে এই ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে নদীর দিকে তাকালে দেখা যায় ঘন কুয়াশা নদীর জলছবির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। চরের মাঝখানে ছোট্ট ছোট্ট বসতি, মানুষজনের ধীর ছন্দের জীবনই কুড়িগ্রাম ভ্রমণের অনন্য অভিজ্ঞতা। যারা ছবি তোলার শখ রাখেন, তাদের জন্য কুড়িগ্রামের সকাল-বিকেল নিখুঁত সময় হবে। চরাঞ্চলে হাঁটতে গেলে পায়ে লেগে থাকবে শিশিরভেজা ঘাস। চারপাশে থাকবে স্নিগ্ধ নিস্তব্ধতা। ভ্রমণকারীরা চাইলে রৌমারী বা রাজীবপুর দিকেও যেতে পারেন। সীমান্তঘেঁষা অঞ্চল হওয়ায় এখানে নদীজীবন, কৃষিকাজ, প্রতিদিনের সংগ্রাম; সবকিছুই একটু অন্য রকম মনে হবে। শীতের হালকা কুয়াশা এসব দৃশ্যকে আরও কোমল করে তোলে।
প্রস্তুতি ও টিপস
শীত উপভোগ করতে গেলেও একটু প্রস্তুতি থাকা ভালো। উত্তরবঙ্গে শীতের কাঠিন্য ঢাকার তুলনায় বেশি, তাই জ্যাকেট বা সোয়েটারের পাশাপাশি টুপি, গ্লাভস, স্কার্ফ সঙ্গে রাখতে হবে। সকালে ঘন কুয়াশা থাকার কারণে রাস্তা পিচ্ছিল হতে পারে, তাই গাড়ি বা বাইক নিয়ে গেলে সাবধানে চলা জরুরি। পঞ্চগড় বা দিনাজপুরে ভ্রমণের সময় স্থানীয় খাবারের স্বাদ নিতে ভুলবেন না। পঞ্চগড়ে কুল, কমলা, নাশপাতিসহ মৌসুমি ফলগুলো শীতে বিশেষ জনপ্রিয়। দিনাজপুরে আবার কচি ধানের ভাত, হাঁসের মাংস বা দুধ-দই; এসব স্থানীয় খাবার ভ্রমণকে আরও আনন্দময় করে তোলে। কুড়িগ্রামে গেলে নদীপাড়ের স্থানীয় বাজার থেকে টাটকা মাছ খেতে পারবেন। হোটেল বা রিসোর্ট বুকিং আগেই করা ভালো, বিশেষ করে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে ভ্রমণকারীর সংখ্যা বাড়ে। বাস বা ট্রেন; উভয় পরিবহনে উত্তরবঙ্গে পৌঁছানো যায় সহজেই। ট্রেনে গেলে যাত্রার সময় জানালার পাশ দিয়ে ভেসে ওঠা কুয়াশাচ্ছন্ন গ্রামাঞ্চল ভ্রমণের আনন্দকে আরও বাড়িয়ে দেয়।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন