চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর ও শিবগঞ্জ উপজেলার পদ্মা নদীঘেঁষা মানুষের জীবনে নেমে এসেছে বিভীষিকাময় সময়। প্রতিদিন ভাঙছে নদীর পাড়, বিলীন হচ্ছে মানুষের স্বপ্ন, জীবনের সবকিছু। অথচ এসব মানুষের দীর্ঘশ্বাস, কান্না, আর্তনাদ যেন কেউ শুনছে না। কেউ দেখছে না।
সদর উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের গাউনিয়া বাগপাড়া থেকে খলিফার চর পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পদ্মা নদীর ভয়াবহ ভাঙন এখন প্রতিদিনের দৃশ্য। এ পর্যন্ত ঘরবাড়ি, হাটবাজার, স্কুল, ক্লিনিক এমনকি ইউনিয়ন পরিষদ ভবন পর্যন্ত পদ্মায় তলিয়ে গেছে। আরও শত শত পরিবার আজ ভাঙনের মুখে দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছে।
‘আমার বাড়িও এক মাসের মধ্যে চলে যাবে নদীতে’ কাঁদতে কাঁদতে বললেন গাউনিয়া বাগপাড়ার বাসিন্দা স্বপন আলী। তিনি বলেন, ‘২০ দিন ধরে ভাঙন চলছে। বহু ঘরবাড়ি চলে গেছে। আমার বাড়িও আর বেশিদিন টিকবে না। বাধ্য হয়ে অন্য জায়গায় জমি কিনেছি। এক মাস পর চলে যাব।’
তিনি ক্ষোভ নিয়ে বলেন, ‘পদ্মাপাড়ের মানুষের কান্না কোনো সরকার বুঝে না। শিক্ষা, চিকিৎসা, সেবা, সবকিছু থেকেই আমরা বঞ্চিত। প্রতিবছর ঘরবাড়ি হারিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করতে হয়।’
দেবীপুর গ্রামের টমাস আলী বলেন, ‘ভাঙন রোধে কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা নেই। কিছু জিও ব্যাগ বা টিউব ফেলে দায়সারা কাজ করা হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে পুরো ইউনিয়নটি পদ্মায় হারিয়ে যাবে।’
দোভাগী ঝাইলপাড়া চর এলাকার বাইরুল ইসলাম জানান, ‘এখানে পাঁচটি গ্রামের প্রায় ২০০ ঘরবাড়ি, স্কুল, মসজিদ, ক্লিনিক সবকিছু হুমকির মুখে। প্রতিদিনই কিছু না কিছু চলে যাচ্ছে নদীতে।’
ভাঙনে ইতোমধ্যে বিলীন হয়েছে নারায়ণপুর বাতাসমোড় কমিউনিটি ক্লিনিক, ফিল্ডবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দোভাগী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চর জগন্নাথপুর মহিলা গার্লস স্কুল, বাদশাপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বহু শিক্ষা ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান। এতে করে শিশুদের শিক্ষা এবং গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবাও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
ভাঙনের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের অনেকেই জেলা প্রশাসনের সহযোগিতার জন্য আবেদন করলেও, ত্রাণ তৎপরতা এখনো প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলে অভিযোগ।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম জানান, ‘ক্ষতিগ্রস্তরা আবেদন করলে সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম আহসান হাবীব বলেন, ‘নারায়ণপুর, মনোহরপুর, ঝাইলপাড়া, পোলাডাঙ্গাসহ প্রায় ২৫ কিলোমিটার এলাকা ঝুঁকিতে রয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে কিছু এলাকায় ভাঙন রোধে জিও ব্যাগ ও টিউব ফেলা হচ্ছে।’
কিন্তু স্থানীয়দের দাবি, এসব পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়, এবং এটি দীর্ঘমেয়াদি কোনো সমাধানও নয়।
পদ্মাপাড়ে যারা জন্মেছে, যাদের শৈশব-যৌবনের স্মৃতি এই নদীর পাড় ঘেঁষে, আজ তারা একরাশ কষ্ট, আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা নিয়ে দিন পার করছে। কিন্তু সেই কান্না যেন রাষ্ট্র-সরকার কিংবা সমাজ, কেউ-ই শুনছে না। এ যেন এক অবহেলিত জনপদের নীরব বিলাপ, পদ্মার পাড়ের মানুষের কান্না কেউ দেখে না।
আপনার মতামত লিখুন :