ঢাকা বুধবার, ১৩ আগস্ট, ২০২৫

তিস্তার ৩৮ পয়েন্টে ভাঙন - দিশাহারা নদীপাড়ের মানুষ

রেজাউল করিম, রংপুর
প্রকাশিত: আগস্ট ১৩, ২০২৫, ০১:২৯ এএম

উত্তরের পাঁচ জেলা- রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা ও নীলফামারীতে তিস্তা নদীতে ৩৮টি পয়েন্টে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। প্রতিদিনই নদীগর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে আবাদি জমি, ঘরবাড়ি ও বসতভিটা। পানি কমা-বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাঙন আরও বেড়ে যাওয়ায় দিশাহারা হয়ে পড়েছেন তিস্তাপাড়ের মানুষ। প্রতিদিনই নদীগর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে আবাদি জমি, ঘর-বাড়ি ও বসতভিটা। কৃষক পরিবারগুলো হারাচ্ছে জীবিকা, ঘরবাড়ি এবং বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বনটুকুও। গত ১০ বছরে তিস্তা কড়াল গ্রাসে হাজার হাজার পরিবার আবাদি জমি ও বসতভিটা হারিয়ে ভূমিহীন হয়ে চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছেন। ভাঙন আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটছে তিস্তা-পাড়ের মানুষের।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের রংপুর বিভাগীয় অফিস সুত্র জানান,  গত ৭ দিনে তিস্তা  ভাঙ্গনে এই ৫ জেলায় ৫৯টি ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ভাঙনের মুখে থাকা শতাধিক ঘরবাড়ি সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, এই পাঁচ জেলায় তিস্তার ৩৮টি পয়েন্টে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনরোধে কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

সরেজমিনে দেখা যায়, মহিষখোঁচা ইউনিয়নের কুটিরপাড় গ্রামে তিস্তার তীরে বসে কূলভাঙার দৃশ্য অপলক দৃষ্টিতে দেখছিলেন কৃষক আকবর আলী (৬৫)। তার চোখে-মুখে পৈতৃক একখ- জমি হারানোর শঙ্কা। তিস্তা নদীর পানিও কমছে, ভাঙনও বাড়ছে। বালাপাড়া গ্রামের ষাটোর্ধ্ব কৃষক মনছুর আলী বলেন, ভিটেমাটি গিলেছে তিস্তা। সব হারিয়ে পরিবার নিয়ে আজ নিঃস্ব আমি।

তিস্তাপাড়ের অলিমা খাতুন (৪৫) আহাজারি করে বলেন, ‘হামাক বাঁচান ব্যাহে, হামার শোগ শ্যাষ। সব নদীত ভাঙিয়া গেইছে ব্যাহে। হামাক বাঁচান। হামরা কই যাম কী খামো, শোগ নদী ভাঙি নিয়া যাবার লাগছে।

তিস্তাপাড়ের অপর এক ভুক্তভোগী তসর উদ্দিন (৫০) বলেন, ‘নদীর মাঝখানে আমার বাড়ি ছিল। বাড়ি ভাঙতে ভাঙতে আজ যেখানে বাড়ি দেখতেছেন তার পাশ পর্যন্ত ভাঙন আসছে। আমার বাড়িটা যেকোনো সময় ভাঙতে পারে। নদীর কিনারত (কাছাকাছি) আসছে ভাঙন। সরকার শুধু হামাক বুঝ দেয়।’

তিস্তাপাড়ের আবুল হোসেন বলেন, ‘আমরা রিলিপ-টিলিপ কিছু চাই না বাহে, বালুর বাঁধ থাকি শুরু করি নদীর পাশে যদি বস্তা দিত তাহলে আর নদী ভাঙত না।

কাউনিয়া উপজেলার টেপামধুপুরের ৫৬ বছর বয়সি কৃষক মেনসের আলী জানান, কয়েক বছরে আগে ২৫ শতক জমি ক্রয় করে বসতবাড়ি নির্মাণ করেছিলেন, প্রায় ২০ শতাংশ আবাদি জমি নদীতে বিলীন হয়েছে। এখন মাত্র পাঁচ শতক জমির ওপর বসতভিটা আছে। এখানে-ওখানে কাজ করে সংসার চলে। তিনি আরো বলেন, আজ রাতের মধ্যেই তাও আবার ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ‘এবার বসতভিটা নদীত চলি গেইলে, আর কোনো জমি থাক পার নয়। নদী হামার শোগ শেষ করি দেলে।’

একই ৫০ বছর বয়সি হাফেজ আলীর ৩০ শতাংশ আবাদি জমি কয়েকদিনের মধ্যে নদীর ভাঙনে বিলীন হয়েছে। এবার বসতভিটা ভাঙনের মুখে। যেকোনো সময় নদীতে বিলীন হতে পারে। হাফেজ আলী বলেন, ‘গত বছর বন্যার সময় নদী অনেক দূরোত আছলো। এবার পানি বাড়া-কমার কারণে তাড়াতাড়ি ভাঙন শুরু হইছে। এবার আর বসতভিটা রক্ষা হওছে না।’

টেপামধুপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদুল ইসলাম বলেন, তার ইউনিয়নের রাজিব, হরিচরণ শর্মা, হয়বতখাঁ, বিশ্বনাথ গ্রামে তিস্তার ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে কথা বলে ৪-৫ হাজার জিও ব্যাগ চেয়ে মাত্র ২৫০টি জিও ব্যাগ বরাদ্দ পাওয়া গেছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।

এলাকাবাসী জানায়, নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে ৬টি ইউনিয়নই তিস্তার তীরবর্তী বন্যাকবলিত এলাকা। বন্যা না হলেও ভারি বর্ষণ হলেই ৬টি ইউনিয়নের বেশ কিছু নি¤œাঞ্চল পানিতে তলিয়ে যায়। তা ছাড়া নদীর বাঁধ ভাঙন প্রবণতা কমবেশি সব সময়ই থাকে। প্রতিবছরই বন্যায় ভাঙনসহ পানিতে তলিয়ে বা ভেসে গিয়ে কয়েক কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়। বর্তমানে খগাখড়িবাড়ী ও খালিশা চাপানি ইউনিয়নের দুটি গ্রাম পূর্ব দুহলপাড়া ও পূর্ব বাইশপুকুর এলাকায় নতুন করে দেখা দিয়েছে নদি ভাঙন। কিছু জায়গায় ভাঙনে বাড়িঘর তলিয়ে যাওয়ার শেষ অপেক্ষায় আবার কিছু জায়গায় ভাঙন বসতবাড়ি থেকে ২ শত থেকে আড়াই শত মিটার দূরে আবস্থান করছে। এলাকাবাসী অভিযোগ করে বলেন, ভাঙন ঠেকানো না গেলে এবারে তারা নিঃস্ব হবেন, রাস্তায় ঠাঁই হবে তাদের।

রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার শহীদুল ইসলাম বলেন, যেসব এলাকায় তিস্তা ভাঙছে সেখানে সরেজমিনে উপজেলা ও জেলা প্রশাসনকে পরিদর্শন করে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে ভাঙন প্রতিরোধে কাজ করতে বলা হয়েছে।