ঢাকা শনিবার, ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ব্যাটারি পুড়িয়ে তৈরি হচ্ছে সিসা!

সাগর আহমেদ, নবীগঞ্জ (হবিগঞ্জ)
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৬, ২০২৫, ০৭:০৮ এএম
ব্যাটারি পুড়িয়ে তৈরি হচ্ছে সিসা!
  • গ্যাসক্ষেত্রের পাশেই গড়ে তোলা হয়েছে কারখানাটি
  • নেওয়া হয়নি পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র
  • কালো ধোঁয়া ও অ্যাসিডের উৎকট গন্ধে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী

হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার আউশকান্দি রোডে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের পাশে ভাড়া নিয়ে অবৈধভাবে একটি সিসা তৈরির কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। কারখানায় পুরোনো ও বাতিল হাওয়া ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা তৈরি করা হচ্ছে। পাশাপাশি ব্যাটারির প্লাস্টিকের কাভারগুলো বিভিন্ন ব্যাটারি তৈরির কারখানায় পাঠানো হয়। ওই কারখানায় প্রতিদিন গড়ে ৪ থেকে ৫ হাজার ব্যাটারি থেকে সিসা আলাদা করা হয়। তবে ব্যাটারি পোড়ানোর কালো ধোঁয়া ও অ্যাসিডের উৎকট গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে এলাকাবাসী। বিশেষ করে ওই সড়ক দিয়ে যাতায়াতকারীরা পড়ছে ক্ষতির মুখে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রহীন ওই কারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত ও ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ ফসলি জমি বেয়ে সরাসরি জোয়ালভাঙ্গার হাওর হয়ে খালের পানিতে মিশে কুশিয়ারা নদীতে চলে যাচ্ছে। এতে করে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। একটি জনগুরুত্বপূর্ণ সড়কের প্রকাশ্যে এমন বেআইনি কার্যক্রম পরিচালিত হলেও স্থানীয় প্রশাসন রয়েছে নির্বিকার।

এদিকে ওই কারখানার পাশেই রয়েছে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র। স্থানীয়রা বলছেন, কারখানাটি গ্যাসক্ষেত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি। কোনো কারণে কারখানায় আগুন বা বিস্ফোরণ ঘটলে পুরো এলাকা পুড়ে ছাই হয়ে যাবে!

এলাকাবাসীর দাবি, গ্যাসক্ষেত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ও জনস্বার্থে পরিবেশ বিধ্বংসী কারখানাটি এখনই বন্ধ করে দেওয়া দরকার।

রায়পুর গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য আজিজুর রহমান বলেন, আউশকান্দি আঞ্চলিক সড়ক দিয়ে হবিগঞ্জ জেলাসহ নবীগঞ্জ বানিয়াচং আজমিরীগঞ্জ উপজেলার শত শত মানুষ প্রতিদিন সিলেটে যাতায়াত করে। কিন্তু সড়কসংলগ্ন ব্যাটারি কারখানা থেকে নির্গত অ্যাসিড ও সিসা পোড়ানো কালো ধোঁয়ায় তারা অতিষ্ঠিত হয়ে ওঠেন। কারখানার পাশেই কুশিয়ারার খাল। এ কারখানার রাসায়নিক পদার্থ খাল বেয়ে সরাসারি জোয়ালভাঙ্গা হাওরে ফসলি জমিতে গিয়ে পড়ছে। ফলে আউশকান্দি চত্বরে প্রাণ-পরিবেশ তথা জীববৈচিত্র্য হুমকির মধ্যে পড়েছে।

মাঈনুদ্দিন খান নামের একজন বলেন, ব্যাটারি পোড়ানো কালো ধোঁয়া ও অ্যাসিডের উৎকট গন্ধে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ধোঁয়ার কু-লী, ছাই বাতাসের মাধ্যমে দূর-দূরান্তেও ছড়িয়ে যায়। রাতে ঘুমানোর উপায় থাকে না। এ ছাড়া, কারখানার পাশেই বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র। কোনো রকম দুর্ঘটনা ঘটলে কী হবে কেউ জানে না! এ কারণে গ্যাসক্ষেত্রের নিরাপত্তার স্বার্থে কারখানাটি বন্ধ করে দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পুরাতন অকেজো ব্যাটারি সংগ্রহ করে আনা হয়েছে। কারখানার ভেতরে ব্যাটারিভর্তি একটি ট্রাক, সেগুলো আনলোড করা হচ্ছে। কিছু শ্রমিক পুরোনো ব্যাটারির ওপরের অংশ খুলে ভেতরের সিসার পাত বের করছেন। অ্যাসিড সংরক্ষণের পর অবশিষ্ট অ্যাসিড মেশানো পানি পাইপ বেয়ে গিয়ে পড়ছে হেদার খালের পানিতে। এরপর পরিষ্কার করা প্রায় ৫ হাজার ব্যাটারির প্লাস্টিকের কভার আরেকটি ট্রাকে লোড করা হচ্ছে।

সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ায় পর কারখানার ম্যানেজার মো জিন্নাহ বলেন, ‘আমি আপনাদের সঙ্গে দেখা করব। নিউজ করলে আমাদের ক্ষতি হয়ে যাবে।’

কারখানায় ১০ থেকে ১২ জন শ্রমিক কাজ করছেন। সবার হাতে প্লাস্টিকের গ্লাভস। তারা পরও তারা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। বগুড়া থেকে কারখানায় কাজ করতে এসেছেন মো. ওয়াজেদ ও হাসান। তারা বলেন, শ্বাসকষ্ট ও চর্ম রোগে ভুগলেও কাজ না থাকায় মাত্র ১৫ হাজার টাকায় এমন বিপজ্জনক কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের কাজ হচ্ছে ব্যাটারি কেটে সিসা গলানো। এসব সিসা পুরোনো কাভারে ভরে নতুন ব্যাটারি তৈরি করা হয়। এ ছাড়া মোবাইল ফোন, ফ্রিজ, টিভি ও টিন তৈরি করতে সিসা লাগে। এ কারণে সিসার রয়েছে ব্যাপক চাহিদা।

কারখানার ম্যানেজার জিন্নাহ বলেন, নবীগঞ্জ রোডের আউশকান্দির বিস্তীর্ণ এলাকা ফাঁকা পড়ে থাকে। ঘনবসতি এলাকায় কারখানা স্থাপন করলে নানা অভিযোগ ওঠে। ফাঁকা এলাকায় এ সমস্যা কম হয়। এ কারণে নবীগঞ্জ অঞ্চলের আউশকান্দি এলাকাকে বেছে নেওয়া হয়েছে।

ওই সিসা কারখানার মালিক হবিগঞ্জ পৌরসভার রাজনগর এলাকার সাবেক কমিশনার রফিকুল বারী চৌধুরী মামুনের ছেলে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা মাহবুবুল বারী চৌধুরী মুবিন। এ বিষয়ে তার সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলতে চাইলে তিনি ব্যস্ত আছেন বলে ফোন কেটে দেন। তবে সংবাদ প্রকাশ করলে সাংবাদিককে দেখে নেওয়া হুমকিও দিয়েছেন।

আউশকান্দি বাজারের ব্যবসায়ীরা বলেন, এসব অবৈধ কারখানা নবীগঞ্জের  পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শুধু ব্যাটারি কারখানা নয়, ইটভাটা, মুরগির খামার জনবসতি এলাকায় স্থাপন করা যাবে না। স্থানীয় জনগণের মতামত উপেক্ষা করে পরিবেশ বিধ্বংসী এসব কারখানা স্থাপন করাও নিষিদ্ধ। তার পরও পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি না নিয়ে যত্রতত্র গড়ে উঠছে নানা কারখানা, যার ফলে এই সড়কের ও আশপাশের প্রাণ-বৈচিত্র্য ক্ষতির মুখে পড়েছে।

উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. প্রত্যয় হাশেম বলেন, কারখানার বিষয়টি আমাদের জানা নেই। খোঁজ নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. ইউসুফ আলী বলেন, ‘সিসা তৈরির কারখানার বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। এমন কোনো কারখানার বিষয়ে আমাদের কাছ থেকে কেউ কোনো ছাড়পত্রও নেয়নি। যদি এমন কারখানা হয়ে থাকে, তাহলে আমরা উচ্ছেদ করব। এ বিষয়ে আমরা অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।’