মহাকাশের অপার রহস্যে মানুষের আগ্রহ চিরকাল। প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে মহাবিশ্বের অজানা তথ্য জানার সুযোগও বাড়ছে। আধুনিক দূরবীক্ষণ যন্ত্র যেমন জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ আমাদের সেই অজানার পথে এক নতুন জানালা খুলে দিয়েছে। সম্প্রতি এই টেলিস্কোপের মাধ্যমে সৌরজগতের সপ্তম গ্রহ ইউরেনাসের এক নতুন উপগ্রহ বা চাঁদের সন্ধান পাওয়া গেছে। ক্ষুদ্র হলেও এই আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মহাকাশ নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। গ্রহ-উপগ্রহের রহস্য কিংবা অদেখা অজানা জগত মানুষের কল্পনাকে নাড়া দেয়। সম্প্রতি সেই কৌতূহলে নতুন মাত্রা যোগ করেছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (ঔডঝঞ)। মহাকাশে স্থাপিত এই আধুনিক দূরবীক্ষণ যন্ত্র এবার আবিষ্কার করেছে সৌরজগতের গ্রহ ইউরেনাসের এক নতুন চাঁদ। চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি জেমস ওয়েবের নিয়ার-ইনফ্রারেড ক্যামেরায় ধারণ করা ছবিতে এই ক্ষুদ্র উপগ্রহটি শনাক্ত হয়। বিজ্ঞানীরা ৪০ মিনিট দীর্ঘ এক্সপোজারের ১০টি ছবি বিশ্লেষণ করে এর অস্তিত্ব নিশ্চিত করেন। আবিষ্কারের নেতৃত্বে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সাউথওয়েস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের একটি গবেষক দল। নতুন এই চাঁদটির ব্যাস মাত্র ৬ মাইল বা প্রায় ১০ কিলোমিটার। অর্থাৎ, পৃথিবীর কোনো একটি ছোট শহরের সমান বড়। জানা গেছে, এটি ইউরেনাসের কেন্দ্র থেকে প্রায় ৩৫ হাজার মাইল দূরে প্রায় বৃত্তাকার একটি কক্ষপথে ঘুরছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই উপগ্রহটি সম্ভবত কাছাকাছি অঞ্চলে গঠিত হয়ে আজও টিকে আছে।
এই আবিষ্কারের ফলে ইউরেনাসের উপগ্রহের সংখ্যা দাঁড়াল ২৯টি। এর মধ্যে রয়েছে ৫টি প্রধান, ১৩টি ছোট এবং আরও ১০টি অনিয়মিত উপগ্রহ। নতুন যোগ হওয়া এই চাঁদটি সেই ছোট দলের অংশ। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন (ওঅট) আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেওয়ার পর এর নামকরণ হবে। ইউরেনাস গ্রহ শুধু তার উপগ্রগুলোর জন্য নয়, বলয়ের জন্যও বিখ্যাত। এর বলয় আর অসংখ্য ছোট চাঁদের মধ্যে জটিল সম্পর্ক বিজ্ঞানীদের দীর্ঘদিনের গবেষণার বিষয়। এসইটিআই ইনস্টিটিউটের গবেষক ম্যাথিউ টিসকারেনো বলেন, ‘অন্য কোনো গ্রহের এত বেশিসংখ্যক ছোট নিজস্ব চাঁদ নেই। এই বলয়-উপগ্রহ ব্যবস্থা ইউরেনাসের অস্থির অতীতের ইঙ্গিত দেয়।’ তার মতে, সদ্য আবিষ্কৃত এই চাঁদটি আকারে এত ছোট যে এটি আগের সবচেয়ে ক্ষুদ্র উপগ্রহটির চেয়েও ছোট ও অনুজ্জ্বল।
কিন্তু আকারে ছোট হলেও এর বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব বিশাল। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই নতুন চাঁদ ইউরেনাসের উপগ্রহ ও বলয় ব্যবস্থার গঠন প্রক্রিয়া সম্পর্কে নতুন আলোকপাত করবে। আমাদের সৌরজগতের প্রতিটি গ্রহেরই নিজস্ব ইতিহাস রয়েছে, যার ছাপ লুকিয়ে থাকে তাদের উপগ্রহ, বলয় কিংবা কক্ষপথে। ছোট একটি উপগ্রহের উপস্থিতি সেই ইতিহাস বোঝার জন্য সূত্র হিসেবে কাজ করে। এ ছাড়া, ইউরেনাসের মতো বরফশীতল গ্রহে কীভাবে এত উপগ্রহ গড়ে উঠল এবং কীভাবে তারা একে অপরের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করছে, তা বোঝার ক্ষেত্রেও এই আবিষ্কার গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতের গবেষণা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারে।
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের চোখে ইউরেনাসের নতুন চাঁদের আবিষ্কার শুধু একটি মহাজাগতিক বস্তু শনাক্ত করার ঘটনা নয়—এটি আমাদের সৌরজগতের গঠন, পরিবর্তন এবং ইতিহাস বোঝার পথে একটি নতুন ধাপ। এমন আবিষ্কার ভবিষ্যতে মহাকাশ গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে আশা করা যায়। ক্ষুদ্র এই উপগ্রহ আমাদের শেখায়, মহাবিশ্বের প্রতিটি কণা—বাবহ সবচেয়ে ছোট উপাদানগুলোও—জ্ঞান ও অনুসন্ধানের জন্য অমূল্য।