সিলেটের বিয়ানীবাজার ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স একসময় প্রসূতিসেবার জন্য দেশসেরার পুরস্কার পেয়েছিল। অথচ মাত্র একজন মেডিকেল অফিসারের ওপর ভর করে চলছে প্রায় ৩ লাখ মানুষের চিকিৎসাসেবা। এতে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন উপজেলাবাসী। বিশেষ করে উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ পার্শ্ববর্তী গোলাপগঞ্জ ও বড়লেখা উপজেলার অসহায় রোগী যারা এখানে সেবা নিতে আসেন, তারাও পড়েছেন বিপাকে।
জানা যায়, প্রসূতিসেবার জন্য পর পর কয়েকবার দেশসেরা হাসপাতালের পুরস্কার পায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। কিন্তু পুরস্কারপ্রাপ্ত হাসপাতালটি চিকিৎসকসহ নানা সংকটে এখন নিজেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। মেডিসিন, চক্ষু, অর্থোপেডিকস, ডেন্টাল, স্ত্রী ও প্রসূতি, সার্জারি, নাক-কান-গলা, আবাসিক মেডিকেল অফিসারসহ হাসপাতালের মোট ২৭টি পদের মধ্যে বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ৫ জন চিকিৎসক। এর মধ্যে ৫ জন চিকিৎসক বেশ কয়েক বছর কর্মস্থলে অনুপস্থিত। তাদের এই অনুপস্থিতির বিষয়টি যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হলেও কোনো সুফল মিলছে না। অনুপস্থিত চিকিৎসকরা কবে ফিরবেন তা-ও জানে না কেউ।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র জানায়, বিয়ানীবাজারে ২৭টি চিকিৎসক পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ৫ জন। এর মধ্যে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ১ জন, আবাসিক মেডিকেল অফিসার ১ জন, গাইনি কনসালটেন্ট ১ জন, কার্ডিওলজি ১ জন ও এনেস্থেসিয়ায় ১ জন কর্মরত থাকলেও এদের কেউ আবাসিক মেডিকেল অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন না। শুধু অপারেশন (অস্ত্রোপচার) হলেও কয়েকজন হাসপাতালে আসেন। প্রায় তিন বছর ধরে চলছে এই অবস্থা। শুধু উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা দিয়েই চলছে সেবা কার্যক্রম। এর মধ্যে অনেক চিকিৎসক এসেছেন, যোগদান করেই আবার বদলি নিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন। এই হিসেবে উপজেলার ৩ লক্ষাধিক মানুষের চিকিৎসাসেবায় আছেন একজন চিকিৎসক।
সূত্র জানায়, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. শেগুফতা শারমিন ২০১০ সালের ১ জুলাই যোগদান করেন। তিনি ২০১১ সালের ১৭ নভেম্বর থেকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত। ১৪ বছর তিনি অনুপস্থিত থাকলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. জুবায়ের আহমদ সিদ্দিকী ২০২৩ সালের ১ মে থেকে অনুপস্থিত। ইনডোর মেডিকেল অফিসার ডা. মো. তানভীরুল ইসলাম ২০২৩ সালের ৫ জুলাই থেকে হাসপাতালে আসেননি। মেডিকেল অফিসার ডা. মোছা. রাবিয়া বেগম ২০২৩ সালের ১২ আগস্ট থেকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত। ডা. মো. নাজমুল সাকিবের দেখা নেই ৩ বছর থেকে। অনুপস্থিত এই চিকিৎসকরা কোথায় আছেন, জানেনা কেউ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারা উচ্চতর ডিগ্রির জন্য বিদেশে অবস্থান করছেন। অনুপস্থিত থাকা এসব চিকিৎসকের মধ্যে আওয়ামীপন্থি চিকিৎসক ছাড়াও শিক্ষা ছুটি, অন্যত্র যুক্ত হওয়া, পছন্দমতো কর্মস্থল না পাওয়ার মতো কারণও রয়েছে। এমনকি বদলীকৃত কর্মস্থলে যোগদান করেই নতুন কর্মস্থলের জন্য সুপারিশ করার মতো ঘটনা ঘটেছে। এতে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
গৃহবধূ তাজরিন ৫ বছরের শিশুসন্তান রুমাইজাকে নিয়ে এসেছেন হাসপাতালে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অতীতে এই হাসপাতালে ভালো চিকিৎসা হলেও এখন এসে আগের মতো সেবা পাচ্ছি না। এখানে কোনো শিশু ডাক্তার নেই। টাকার অভাবে ভালো ডাক্তার দেখাতেও পারছি না। ভাবছিলাম, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাব কিন্তু এখানে সেই ব্যবস্থাও নেই।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) উপজেলা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট আমান উদ্দিন বলেন, বিয়ানীবাজাররের মতো একটি বড় উপজেলার জনসংখ্যা ও রোগীর তুলনায় একজন মেডিকেল অফিসার দিয়ে চিকিৎসা দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। রোগীরা এসে পর্যাপ্ত সেবা পাচ্ছে না, যেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আশা করি, কর্তৃপক্ষ দ্রুত পর্যাপ্ত চিকিৎসকের ব্যবস্থা করবেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মনিরুল হক খান জানান, কয়েকজন চিকিৎসক ওএসডি, কিছু বদলি আবার কয়েকজন অনুপস্থিত আছেন। বিষয়টি যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে জানানো হয়েছে।
সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. নাসির উদ্দিন বলেন, অনুপস্থিত চিকিৎকদের কাছে দফায়-দফায় চিঠি দেওয়া হচ্ছে। যথাযথ কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা না নিলে কী করার আছে? তারপরেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠানো হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার আলম বলেন, খারাপ পোস্টিং হয়েছে দাবি করে অনেকে কর্মস্থলে যেতে চায় না। এখন সেই সময় আর নেই। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। অনুপস্থিত চিকিৎসকের বিষয়ে আর ছাড় দেওয়া হবে না। যথাযথ প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন