ঢাকা মঙ্গলবার, ০২ ডিসেম্বর, ২০২৫

অবৈধ করাতকলে উজাড় হচ্ছে বন

মনিরুজ্জামান মনির, টাঙ্গাইল
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২, ২০২৫, ০৭:২৭ এএম

*** জেলায় ৫৩৯টির মধ্যে ৩৭৬টির নেই অনুমোদন
*** স্থানীয় প্রশাসন ও বনবিভাগ জরিমানা করলেও থেমে নেই অবৈধ কাঠ চিরাই-পাচার
*** মধুপুরে সাড়ে ৪৫ হাজার একর বনাঞ্চলের মধ্যে বৃক্ষশূন্য ৩৫ হাজার একর
*** প্রাকৃতিক বন থেকে বিলুপ্তি হচ্ছে শাল-গজারিসহ নানা গাছ
*** বনবিভাগকে মাসিক চাঁদা দিয়েই চলছে অবৈধ করাতকল

টাঙ্গাইলে প্রায় ১ লাখ ২২ হাজার ৮৭৬ একর বনভূমি বিস্তৃত, যা মধুপুর, ঘাটাইল, কালিহাতী, সখীপুর ও মির্জাপুর এলাকায় ছড়িয়ে আছে। এই বনাঞ্চলকে ঘিরে এবং জেলার বিভিন্ন এলাকাসহ সর্বমোট ৫৩৯টি করাতকল রয়েছে। এর মধ্যে অনুমোদন রয়েছে ১৬৩টির বাকি ৩৭৬টি সম্পূর্ণ অবৈধ। এসব করাতকলে প্রতিদিন চিরানো হচ্ছে বনের বৃক্ষ, পাচার হচ্ছে কাঠ, ফলে বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়ছে বনাঞ্চল। স্থানীয় প্রশাসন ও বনবিভাগ অনুমোদনহীন করাতকল মালিকদের জরিমানা করলেও থেমে নেই অবৈধ কাঠ চিরাই-পাচার। বনাঞ্চলসহ পরিবেশ রক্ষায় বিভিন্ন উপজেলায় রয়েছে বন ও পরিবেশ কমিটি। এই কমিটির কার্যক্রম চলছে শুধু কাগজে-কলমে।

সরেজমিনে দেখা যায়, অবৈধ করাতকল স্থাপন করা হয়েছে কোথাও সামাজিক ও সংরক্ষিত বন ঘেঁষে আবার কোথাও বনের ভেতর। রেঞ্জ ও বিট অফিসের নাকের ডগায় করাতকল স্থাপন করে দিনরাত চলছে বৈধ ও অবৈধ কাঠ চিরাই। অবৈধভাবে সংরক্ষিত বন থেকে শাল-গজারি গাছ কেটে এসব করাতকলে চিরাই করলেই হয়ে যায় বৈধ। অথচ বন আইনে বলা আছে বনাঞ্চলের ১০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে করাতকল স্থাপন করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এদিকে, স্থানীয়দের অভিযোগ বন বিভাগের লোকদের চোখ ফাঁকি দিয়ে করাতকল স্থাপন করা কোনোভাবেই সম্ভব না। প্রাকৃতিক বন থেকে শাল-গজারি বিলুপ্তির জন্য দায়ী অবৈধ করাতকল।

করাতকলগুলো ঘুরে দেখা যায়, মিল চালানোর ক্ষেত্রে বিধিবিধান মানছেন না করাতকলের মালিকরা। অনেকেই ১০-১৫ বছর ধরে অনুমোদন ছাড়াই চালাচ্ছেন করাতকল। করাতকলের চত্বরে মজুত রাখছেন বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলছে কাঠ কাটার কাজ।

কোনো কোনো এলাকায় নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে গড়ে উঠেছে বেশকিছু করাতকল। এ কারণে শব্দদূষণের শিকার হচ্ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী এসব অবৈধ করাতকল থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায় করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ এবং সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। করাতকল থেকে স্থানীয় বনবিভাগ ২০০০-৫০০০ টাকা করে মাসিক চাঁদা নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।

টাঙ্গাইল বন বিভাগের আওতাধীন বনাঞ্চলে মোট ৯টি রেঞ্জ রয়েছে। রেঞ্জগুলো হলো- টাঙ্গাইল সদর রেঞ্জ, ধলাপাড়া রেঞ্জ, হতেয়া রেঞ্জ, বহেড়াতলী রেঞ্জ, বাঁশতৈল রেঞ্জ, অরণখোলা রেঞ্জ, মধুপুর রেঞ্জ, দোখলা রেঞ্জ ও মধুপুর জাতীয় উদ্যান সদর রেঞ্জ। এই ৯টি রেঞ্জের আওতায় ৩৪টি বিট, ৩টি সামাজিক বনায়ন নার্সারি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ৯টি উপজেলা সামাজিক বনায়ন কেন্দ্র রয়েছে।

মধুপুরে সাড়ে ৪৫ হাজার একর বনাঞ্চলের ৩৫ হাজার একর সম্পূর্ণ বৃক্ষশূন্য হয়ে গেছে। এসব বনভূমি এখন আনারস, কলা, ড্রাগনসহ নানা কৃষি ফসলের খেতে পরিণত হয়েছে। বাকি ১০ হাজার একরও ক্ষয়িষ্ণু। মধুপুর উপজেলায় ৯০টি করাতকল রয়েছে, এর মধ্যে ৭৩টিরই লাইসেন্স নেই।

ঘাটাইল ধলাপাড়া রেঞ্জ অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় মোট করাতকল রয়েছে ৯০টি, যার মধ্যে নিবন্ধন নেই ৪৫টির। পৌরসভা এবং আশপাশের এলাকায় মাত্র ১০টি করাতকলের নিবন্ধন রয়েছে। ঘাটাইলে সামাজিক ও সংরক্ষিত বনভূমির পরিমাণ ২৫ হাজার ৭১১ একর। এই ভূমি দেখ-ভালের জন্য রয়েছে বন বিভাগের একটি রেঞ্জের আওতায় ছয়টি বিট অফিস।

উপজেলার সংগ্রামপুর ইউনিয়নের দেওজানা বাজার করাতকল মালিক ইদ্রিস আলী জানান, বনের ভেতর মিল চালানো অবৈধ আমার মিলের কোনো কাগজপত্র নেই। বন বিভাগের লোকজন আসলে সামান্য খরচ দিয়ে চা খাওয়াইয়া বিদায় করি।

সংগ্রামপুর ইউনিয়নের মাস্টারবাড়ি মোড় করাতকলের শ্রমিক বাবুল হোসেন বলেন, বন কর্মকর্তারা অভিযানে আসছিল বিট অফিসার টাকা-পয়সা ভালোই খাইছে তারপরও আমাদের হয়রানি করেছে। অবৈধ করাতকলের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান আছে বলে দাবি করেন ধলাপাড়া রেঞ্জ কর্মকর্তা সাব্বির হোসাইন। সম্প্রতি ছয়টি অবৈধ করাতকল গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। সখীপুর উপজেলায় উপজেলায় শতাধিকের উপরের করাতকল আছে। এর মধ্যে ১২টির লাইসেন্স আছে। সম্প্রতি কয়েকজন লাইসেন্স নবায়নের আবেদন করেছেন। এ ছাড়াও কালিহাতী ও মির্জাপুরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায়ও লাইসেন্সবিহীন করাতকল রয়েছে । হরহামেশাই চিরানো হচ্ছে বিভিন্ন বনজ বৃক্ষ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক করাতকল মালিক বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আমাদের ‘স’ মিল চলছে। আবেদন করেছি, কিন্তু এখনো অনুমোদন পাইনি।’ তাহলে এখন কীভাবে কল চলছে? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বন বিভাগের লোকজনকে ম্যানেজ করে মিল চালাচ্ছি।’ তাদের মাসিক চাঁদা নেই। জেলা থেকে কোনো অভিযান আসলে এরা আমাদের আগেই জানিয়ে দেয়।

কাঠ ব্যবসায়ী মাসুদ রানা বলেন, ‘আমরা কাঠের ব্যবসা করি। এই ব্যবসা করে আমাদের সংসারের খরচ চলে। মিলের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক। আমরা দেখি, মাঝেমধ্যে বন বিভাগের লোকজন এসে মিল থেকে টাকা নিয়ে যায়। এতে মিল মালিকদের আর কোনো ঝামেলা হয় না।’ একই ধরনের কথা বলেনÑ কাঠ ব্যবসায়ী রফিক ও তৈয়ব মিয়া।

পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলা’র বিভাগীয় সমন্বয়কারী গৌতম চন্দ্র চন্দ বলেন, করাতকল বিধিমালা ২০১২ অনুযায়ী, সংরক্ষিত, রক্ষিত ও সরকারি বনভূমির সীমানা থেকে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে করাতকল স্থাপন নিষিদ্ধ। এই বিধি লঙ্ঘন করলে জেল জরিমানার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু টাঙ্গাইলের বেশিরভাগ করাতকলই অবৈধ। এগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে উচ্ছেদ করে মালামাল জব্দ না করলে বনাঞ্চল সম্পূর্ণ বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়বে। পরিবেশ প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে।

টাঙ্গাইল বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, জেলায় ৫৩৯টি করাতকল আছে, এরমধ্যে ১৬৩টি করাতকলকে বিধি মোতবেক অনুমতি দেওয়া হয়েছে, বাকি যেগুলো রয়েছে সেগুলো অবৈধ। এ অবৈধ করাতকলগুলো জেলার ১২টি উপজেলাতে অবস্থিত, সব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবৈধ করাতকলের তালিকা দেওয়া হয়েছে, আমরা প্রতি মাসেই অবৈধ করাতকল উচ্ছেদ করার জন্য অভিযান পরিচালনা করে থাকি, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার (ভূমি),বন বিভাগের কর্মকর্তা এবং যৌথ বাহিনীসহ এ অভিযান পরিচালিত হয়। গত মাসে সাতটি অভিযান পরিচালিত হয়েছে এবং এ মাসেও একটি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। অবৈধ করাতকল উচ্ছেদ করার জন্য পর্যায়ক্রমে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।