ক্ষোভ থাকলেও ভোটের প্রস্তুতিতে সন্তুষ্ট বিএনপি।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবেÑ এমন প্রশ্ন শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর নয়, দেশের মানুষের মনেও। ডিসেম্বর, ফেব্রুয়ারি নাকি এপ্রিলে? সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে তারিখ ঘোষণা না করায় চাপা ক্ষোভ আছে বিএনপিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দলের মধ্যে। 
গত ঈদুল আজহার আগের দিন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ২০২৬ সালের এপ্রিল মাসে জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তাতে বিএনপি ক্ষোভ প্রকাশ করলেও লন্ডনে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকের পর বরফ গলে। চলতি বছরের ডিসেম্বরে নির্বাচনের দাবিতে অনড় বিএনপি রাজি হয় ফেব্রুয়ারিতে ভোটের জন্য, তবে রমজান শুরুর আগেই চায় জাতীয় নির্বাচন। এরই মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশন। বৈঠক শেষে কোনো পক্ষ থেকে আলোচনার বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি। তারপর কয়েক দিন কমিশন অনুপস্থিত থাকায় গুঞ্জন ছড়ায়, পদত্যাগ করছেন প্রধান উপদেষ্টা। যদিও সেই গুঞ্জন উড়িয়ে দিয়ে তিন দিন আগে সিইসি জানিয়েছেন, নির্বাচনের তারিখ তিনি নিজেও জানেন না। এরই মধ্যে গত বুধবার ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। সংবাদ সম্মেলনে এমন তথ্যই জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেন, সংস্কারসহ সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে আগামী রোজার আগেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে পারে। নির্বাচন ঘিরে সব ধরনের প্রস্তুতি ডিসেম্বরের মধ্যে নিতে বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা। ডিসেম্বরের মধ্যে সব প্রস্তুতিও শেষ করতে বলেছেন তিনি। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ৮ লাখ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত থাকবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সব সদস্যকে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করতে হবে। একই সঙ্গে আগামী মাসগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও কঠোর হতে বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা। 
নির্বাচনের ইঙ্গিত দিলেও কবে হবে সেই নির্বাচন, সেই কথা এবারও স্পষ্ট করেননি প্রেস সচিব। বিএনপি নেতারা বলছেন, ঝেড়ে কাশছে না সরকার। সব সময় কৌশলী কথা বলছেন তারা। কথার মধ্যে রাখেন শর্তÑ যদি, কিন্তু, তবে। এভাবে রাজনীতি হয় না বলেও মনে করেন বিএনপি নেতারা। 
এদিকে ডিসেম্বরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে প্রধান উপদেষ্টার পদক্ষেপে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে বিএনপি। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের এক আলোচনাসভায় এ কথা জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিএনপি মহাসচিব বলেন, মানুষ দ্রুত নির্বাচিত সংসদ দেখতে চায়। সব প্রস্তুতি শেষ করে নির্বাচন কমিশন দ্রুত ভোটের আয়োজন করবে বলে আশাবাদী বিএনপি।
সংস্কার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বেশির ভাগ সংস্কার প্রস্তাবে বিএনপি একমত। কিন্তু কিছু মৌলিক বিষয়ে আমরা একমত নই। তবে পরবর্তী সংসদ সেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বলে মত দিয়েছি।
এদিকে সংস্কার ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের সংলাপ চলমান। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার সময়সীমা, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, উচ্চ আদালতের বিকেন্দ্রীকরণসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে এরই মধ্যে একমত সব রাজনৈতিক দল। বিএনপি দীর্ঘদিনের প্রচলিত প্রথা ভেঙে বের হয়ে এসেছে বলে মনে করছে দলটির নেতারা। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, সবচেয়ে বড় দল হিসেবে বেশি ছাড় দিচ্ছে বিএনপি। তার প্রতিফলন চারটি কমিশনের মোট ৫৮৭ প্রস্তাবের মধ্যে ৪৩৬টিতেই একমত হয়ে সংস্কার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়েছে বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। 
সব দল নয়; বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে পৌঁছে জুলাই কিংবা জাতীয় সনদ তৈরির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা। বলেছেন, পরস্পর দোষারোপ নয়, ডেডলাইন দিয়ে আলোচনা দ্রুত সমাপ্ত করতে হবে। মৌলিক ৮ থেকে ১০টি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে একমত হলেই ট্র্যাকে ওঠা সম্ভব। বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে চূড়ান্ত মতামত সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছে। জিয়াউর রহমান একদলীয় থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংযুক্ত করেছেন। কিন্তু এখন কেউ কেউ বলছে, বিএনপি সংস্কারে বাধা দিচ্ছে।
তবে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন, সাংবিধানিক পদে নিয়োগ কমিটিসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে মতভিন্নতা দীর্ঘসূত্রতা তৈরি করছে। তাই বড় দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে পৌঁছার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা। বলেছেন, দ্রুত জাতীয় কিংবা জুলাই সনদ তৈরিতে এর বিকল্প নেই। এরই অংশ হিসেবে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির কাছে পুনরায় ঘোষণাপত্রের খসড়া পাঠিয়ে মতামত চেয়েছে সরকার। গত মঙ্গল ও বুধবার রাতে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এই খসড়া ঘোষণাপত্র পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ করে কিছুটা সংযোজন-বিয়োজনের মধ্য দিয়ে তা চূড়ান্ত করেছে দলটি। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানকে ধারণ করার বিষয়ে একমতের পাশাপাশি একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বরকেও জুলাই ঘোষণাপত্রে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলে আসছিল। ঘোষণাপত্রের নতুন খসড়ায় এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এ ব্যাপারে বিএনপি ইতিবাচক। তবে সংবিধান পুনর্লিখনের বিপক্ষে মত দিয়েছে দলটি। জুলাই ঘোষণাপত্রে সংবিধানের মৌলিক বিষয় অক্ষুণœ ও মুজিবনগর সরকারের স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার পক্ষে বিএনপি। শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় গণতন্ত্র ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাÑ এই দুই বিষয়কেও ঘোষণাপত্রে গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়ে মত দেওয়া হয়েছে। আগামী দু-এক দিনের মধ্যে ঘোষণাপত্র খসড়ার একটি কপি সরকারকে পৌঁছে দেবে বিএনপি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমরা আশা করি, সরকার কথা রাখবে। ডিসেম্বরে দেয়নি ফেব্রুয়ারিতে দিলেও মেনে নেবে বিএনপি; কিন্তু নির্বাচন নিয়ে কোনো চালাকি করলে মেনে নেবে না দেশের মানুষ। এই সরকার যে ব্যর্থ, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তারা একটি সুন্দর নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে দেশের মানুষ তাদের সম্মানের চোখে দেখবে। নির্বাচন না দিয়ে চালাকি করলে পরিণতি ভোগ করতে হবে। স্বৈরাচার হাসিনাকে কী দেশের মানুষ সুন্দরভাবে বিদায় দিয়েছেÑ তাদের পালাতে হয়েছে। এখন যারা ক্ষমতায় আছেন নিশ্চই এত দ্রুত তারা ইতিহাস ভুলে যাননি। 
পারস্পরিক দোষারোপ নয়; মতভিন্নতা কাটাতে আলোচনার ডেডলাইন প্রয়োজন বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইস্যুতে একমত হলেই ফলাফল ইতিবাচক হবে বলে মত তাদের। সংস্কার আলোচনায় গ্রহণযোগ্য ইস্যুতে কারো দ্বিমত পোষণ করা রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন তারা।