এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম, তার স্ত্রী ফারজানা পারভীন, তাদের সন্তান ও এক জামাতার নামে সিঙ্গাপুরে থাকা সম্পদ জব্দ ও বাজেয়াপ্তের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের প্রেক্ষিতে গতকাল বৃহস্পতবিার ঢাকা মেট্রোপলিটান সিনিয়র স্পেশাল জজ মো. জাকরি হোসেন সম্পদ জব্দের আদেশ দেন। দুদকের উপপরিচালক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তাহসিন মোনাবিল হক এসব সম্পদ জব্দের আদেশ চেয়ে আদালতে আবেদন করেছিলেন।
তার আবেদনে গত বুধবার এস আলমের নামে তিন ব্যাংকে থাকা ৫৩টি হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ দেন একই আদালত। গত ২৪ জুন এস আলমের সাইপ্রাসে থাকা দোতলা বাড়ি জব্দের আদেশ দেন আদালত। এ ছাড়া সাইফুল আলম ও তার স্ত্রী ফারজানা পারভীনের নামে ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জে থাকা ১৯ কোম্পানির শেয়ার ও জার্সিতে থাকা ছয়টি ট্রাস্ট কোম্পানির শেয়ার অবরুদ্ধের আদেশ দেওয়া হয়।
চট্টগ্রামভিত্তিক এই শিল্পগোষ্ঠীর কর্ণধার এস আলমের বিরুদ্ধে ব্যাংক খাতে অনিয়ম-লুটপাট ও অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে-পরে আলোচনায় ছিলেন এই ব্যবসায়ী ও তার পরিবার। পরে এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যাংকগুলোয় নতুন পর্ষদ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গভর্নরের দায়িত্ব নেওয়ার পর আহসান এইচ মনসুর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক এসব ব্যাংক থেকে বহু টাকা নিয়েছে এস আলম। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরে সে বছর আগস্ট মাসে সিঙ্গাপুরে এক বিলিয়ন ডলার পাচারের অভিযোগে এস আলম ও তার স্ত্রী ফারজানা পারভীনের বিরুদ্ধে বন্ধ থাকা অনুসন্ধান আবারও শুরু করে দুদক।
২০২৩ সালে দুদক অনুসন্ধানে নামলেও ওই বছরের ২৪ আগস্ট তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ও দুদকের অনুসন্ধান সম্পর্কিত বিষয়ের ওপর স্থিতাবস্থা জারি করেন হাইকোর্ট। এরপর গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি তাদের বিরুদ্ধে ‘অর্থ পাচারের’ অভিযোগের অনুসন্ধান নিয়ে পাঁচ মাস আগে হাইকোর্টের দেওয়া স্বতঃপ্রণোদিত রুল খারিজ করেন আপিল বিভাগ। এতে অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়। সেই আদেশের কপি পাওয়ার পর অনুসন্ধানটি পুনরায় শুরু করে দুদক। নথিপত্র চেয়ে চিঠিও পাঠানো হয় বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-বিএফআইইউকে। দুদক ২০২৩ সালের ১৩ অগাস্ট এ বিষয়ে অনুসন্ধান শুরুর উদ্যোগ নেয় ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারে ৪ অগাস্ট প্রকাশিত ‘এস আলম’স আলাদিন’স ল্যাম্প’ শিরোনামে প্রতিবেদনের ভিত্তিতে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এস আলম গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ সাইফুল আলম সিঙ্গাপুরে কমপক্ষে ১ বিলিয়ন ডলারের ব্যাবসায়িক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। যদিও বিদেশে বিনিয়োগ বা অর্থ স্থানান্তরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে এ-সংক্রান্ত কোনো অনুমতি তিনি নেননি।
গত বছরের নভেম্বরে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি আয়োজিত এক আলোচনায় সভায় প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেছিলেন, ‘সম্প্রতি একটি শিল্প গ্রুপের মালিক নিজেকে সিঙ্গাপুরের নাগরিক দাবি করে বাংলাদেশ ব্যাংক তাকে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করছে বলে অভিযোগ করেছেন। এস আলম গ্রুপের এই কর্ণধার বলেছেন, তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর কর্তৃক ভিত্তিহীন ও উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়ায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সালিশি মামলা করতে পারেন।’
গত বছরের ৭ অক্টোবর এস আলম ও তার স্ত্রী ফারজানা পারভীনসহ তার পরিবারের ১২ সদস্যের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত। চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি এস আলম পরিবারের ৩ হাজার ৫৬৩ কোটি ৮৪ লাখ ২১ হাজার টাকার শেয়ার অবরুদ্ধ করার আদেশ দেওয়া হয়। এরপর ৩ ফেব্রুয়ারি ৩৬৮ কোটি ২৫ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ টাকা মূল্যের ১৭৫ বিঘা সম্পদ জব্দের আদেশ দেওয়া হয়। ১২ ফেব্রুয়ারি ৪৩৭ কোটি ৮৫ লাখ ২ হাজার ২৭৪টি শেয়ার অবরুদ্ধের আদেশ দেন আদালত। এসব শেয়ারের দাম ৫ হাজার ১০৯ কোটি টাকা। এস আলমের ৮ হাজার ১৩৩ কোটি ৫৬ লাখ ৭২ হাজার টাকা মূল্যের শেয়ার অবরুদ্ধ করার আদেশ দেওয়া হয় ২৩ ফেব্রুয়ারি।
১০ মার্চ এস আলমের ১ হাজার ৬ বিঘা জমি জব্দের আদেশ দেন আদালত। ৯ এপ্রিল তার ৯০ বিঘা জমি জব্দের আদেশ দেওয়া হয়। একই দিন আদালত তার ঘনিষ্ঠজনদের নামে থাকা ৩৭৪টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার আদেশ আসে। এরপর ১৭ এপ্রিল এস আলম ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্টদের নামে থাকা ১ হাজার ৩৬০টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ দেওয়া হয়।
আপনার মতামত লিখুন :