রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একটি শেরেবাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়। যা একসময় নারী শিক্ষা মন্দির নামে পরিচিত ছিল। প্রায় শতবছর থেকে শিক্ষার আলো ছড়ানো এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা সংকট। নানা অজুুহাতে প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডি ২৫ জন শিক্ষককে বাদ দেওয়ার পাঁয়তারা করছে। ইতোমধ্যে দুজন শিক্ষককে বাদও দেওয়া হয়েছে। এতে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে এই প্রতিষ্ঠানটিতে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত বিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বর্তমানে প্রায় চার হাজার। এসব শিক্ষার্থীর বিপরীতে এমপিওভুক্ত শিক্ষকের সংখ্যা মাত্র ১৪। এত স্বল্পসংখ্যক শিক্ষক নিয়ে এত শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাতে হিমশিম খেতে হয়। দীর্ঘদিন থেকে এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক সংকট দেখা দিলে কর্তৃপক্ষ চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক নেওয়া শুরু করে। ইতোমধ্যে প্রায় ৩২ জন শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এই প্রক্রিয়ায়। যাদের কেউ কেউ দুই থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত শিক্ষকতা করছেন।
সূত্র জানায়, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া এই ৩২ জন শিক্ষকদের মধ্যে ১৯ জনকে স্থায়ী করেছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি এই শিক্ষকদের মধ্যে ২৫ জনের নিয়োগ অবৈধ দেখিয়ে বাদ দেওয়ার পাঁয়তারা করা হচ্ছে। এর মধ্যে আকলিমা আক্তার ও রাজিব দাস নামের দুই শিক্ষককে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সম্প্রতি এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্ত রিপোর্টের আলোকে বিদ্যালয়টির ২৫ জন শিক্ষকের নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে বিদ্যালয়টির বর্তমান সভাপতি তাদের চাকরি নিয়মিত করার জন্য একটি দৈনিক পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছেন। নিয়োগ অবৈধ হওয়ায় ওই শিক্ষকদের নাম উল্লেখ করে নতুন করে আবেদন করার জন্য বলেন।
ডিআইএ’র যে রিপোর্টের আলোকে এই শিক্ষকদের নিয়োগ অবৈধ বলা হয়েছে, সেই রিপোর্টে দেখা যায়, অধিকাংশের ক্ষেত্রে নিয়োগ দেওয়ার সময় গভর্নিং বডির রেজুলেশন করা হয়নি। অধ্যক্ষ কর্তৃক নিয়োগপত্রের পরিপ্রেক্ষিতে তারা যোগদান করেন। যোগদানপত্রও পাওয়া যায়নি অনেকের। কারো বলা হচ্ছে নিয়োগপত্র নেই আবার কারো ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে নিবন্ধন সনদ নেই কিংবা তার কোনো রেকর্ড সরবরাহ করা হয়নি। ২০২৪ সালের ১৪ নভেম্বর বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করে এই রিপোর্ট জমা দিয়েছেন ডিআইএ’র উপপরিচালক মো. ওয়াজকুরনী ও অডিট অফিসার চন্দর কুমার দেব।
ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, সব শিক্ষককে প্রথমে মৌখিকভাবে নিয়োগ প্রদান করা হয় এবং যোগদানের কয়েক বছর পর তাদের নিয়োগ অনুমোদন করা হয়। তবে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালায় এবং এমপিও নীতিমালায় খ-কালীন কোনো শিক্ষকের পদ নেই এবং খ-কালীন শিক্ষক নিয়োগে কোনো বিধি নেই। খ-কালীন শিক্ষকদের নিয়োগও বিধিসম্মত হয়নি। এ ছাড়াও শিক্ষকদের নিয়োগে বেতন বৈষম্যও রয়েছে। তবে খ-কালীন শিক্ষকদের নিয়োগ এবং বেতন প্রদানের কোনো বিধিবিধান না থাকায় খ-কালীন শিক্ষকদের বেতন নির্ধারণের বিষয়ে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ গভর্নিং বডির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে।
এর আগে ২০১৮ সালে বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে আরেকটি প্রতিবেদন দিয়েছিল ডিআইএ। ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, চুক্তিভিত্তিক এসব শিক্ষককে অতীত নথিপত্র নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা হয়নি। তবে কর্মরত খ-কালীন শিক্ষকগণ প্যাটার্ন অতিরিক্ত হিসেবে গণ্য। তারা সরকারি-বেতনভাতা প্রাপ্ত হবেন না।
তবে কর্মরত ওই শিক্ষকরা বলেন, আমরা কেউ কেউ ২ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। এত বছর কেন আমাদের নিয়োগ বৈধ হয়নি সেই প্রশ্ন সামনে আসবে। আর যে প্রতিবেদনের আলোকে আমাদের অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে, সেই প্রতিবেদনে আমাদের অবৈধ কিংবা চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হয়নি। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমাদের বাদ দিতে চাচ্ছে।
তারা আরও বলেন, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেওয়া প্রতিবেদনে আমাদের নিয়োগ নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলা হলো না। কিন্তু নভেম্বরে কেন প্রশ্ন তোলা হলো এটা আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না।
বিদ্যালয়টির গভর্নিং বডির এডহক কমিটির এক সদস্য জানান, চার সদস্যের এডহক কমিটির সভাপতি একাই বাদ দেওয়ার পক্ষে। বাকিরা এই শিক্ষকদের বাদ দিতে চাচ্ছেন না।
বিদ্যালয়টি থেকে সম্প্রতি অব্যাহতি পাওয়া শিক্ষক আকলিমা বেগম বলেন, আমি প্রায় ১৩ বছর এই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে আসছি। আমাদের সরকারি কোনো বেতন হতো না। বিদ্যালয় থেকে নামমাত্র বেতনেই আমরা চাকরি করেছি। মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদ্যালয়টির সভাপতি আওয়ামী লীগ নেতা রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজের নানা অনৈতিক কর্মকা- নিয়ে প্রতিবাদ করায় আমাদের টার্গেট করা হয়েছে। এখন একটি অহেতুক অভিযোগ তুলে আমাদের বাদ দেওয়া হচ্ছে। আমাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে নিয়োগ বৈধ নয়, তা এতদিন যাচাই করা হলো না কেন? আগেও ডিআইএ তদন্ত করেছে তখন তো তারা এই অভিযোগ তুলেনি। মূলত আমাদের বাদ দিয়ে সভাপতি তার পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ দিতে এই পাঁয়তারা করছে।
এ প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) মাকসুদা বেগম বলেন, তাদের বাদ দেওয়া হচ্ছে না। তবে আগে তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ছিল না। নিয়োগে নানা ত্রুটি রয়েছে। এখন নতুন করে তাদের নিয়োগ দিয়ে একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে আনতে চাচ্ছি।
ডিআইএ’র দুই রিপোর্টে দুই রকম প্রতিবেদন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগের প্রতিবেদনে হয়তো এসব বিষয় কোনো কারণে ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। তবে সর্বশেষ প্রতিবেদনে এসব শিক্ষকের সম্পর্কে আপত্তি এসেছে। এই আপত্তি আসার পরই তাদের নতুন করে নিয়োগের চেষ্টা চলছে।
এডহক কমিটির সভাপতি জাকির হোসেন কামাল বলেন, এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলেন। আমি কিছু বলতে পারব না।