অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে নারী ফুটবলারদের গল্পটা পুরোপুরি ভিন্ন। তাদের জীবনের গল্প সবসময় হৃদয়কে নাড়া দেয়। যে পর্যায় থেকে উঠে এসে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে গৌরবান্বিত করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন নারী ফুটবলাররা, সেটি ভাবলেই বুকটা গর্বে ভরে ওঠে। একের পর এক ইতিহাস গড়ে দেশের নারী ফুটরলে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন তারা। মাঠের লড়াইয়ে তাদের আত্মবিশ^াসের সঙ্গে অদমনীয় মনোভাব, জয়ের ক্ষুধা আর সাফল্য পাওয়ার যে তাড়না, সেটি নারী ফুটবলারদের পৌঁছে দিয়েছে অন্য উচ্চতায়। তারা প্রমাণ করেছেন, তাদের পক্ষে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। ফুটবলের প্রতি তাদের যে প্রচ- আবেগ ও ভালোবাসা, সেটিই নারী ফুটবলারদের সবচেয়ে বড় শক্তি। আর সেই শক্তি বলেই দেশের নারী ফুটবলের অভূতপূর্ব সাফল্যময় অগ্রযাত্রা হচ্ছে।
গত ৩১ মে থেকে এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশ কিছু ঐতিহাসিক সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশের নারী ফুটবলাররা। মে-জুনে জর্ডানের গিয়ে র্যাঙ্কিংয়ে অনেক এগিয়ে থাকা দলকে রুখে দেয় তারা। স্বাগতিক জর্ডানের বিপক্ষে ২-২ গোলে ড্র করার আগে ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষেও ড্র করে (গোলশূন্য) বাংলাদেশ জাতীয় নারী দল। এই দুটি ম্যাচে পাওয়া আত্মবিশ^াস কাজে লাগিয়ে মিয়ানমারে গিয়ে ইতিহাস গড়ে মেয়েরা। সেখানে এশিয়ান কাপ বাছাই পর্বে তিনটি ম্যাচ খেলে তারা। প্রথম ম্যাচে র্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা বাইরাইনকে ৭-০ গোলে হারায় বাংলাদেশ। পরের ম্যাচে প্রবল প্রতিপক্ষ স্বাগতিক মিয়ানমারকে ২-১ গোলে হারানোর গৌরব অর্জন করে ঋতুপর্না, মরিয়ারা।
এরপর তুর্কমেনিস্তানের বিপক্ষে ৭-০ গোলে জয় তুলে নিয়ে প্রথমবারের মতো নারী এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে উঠে বাংলাদেশের মেয়েরা। এশিয়ান কাপ বাছাই পর্বে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স প্রদর্শন করার পর ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ঈর্ষণীয় সাফল্য পায় বাংলাদেশ। রেকর্ড ২৪ ধাপ এগিয়ে ১২৮তম থেকে ১০৪তম অবস্থানে উঠে আসে নারী দল। ফিফাও বাংলাদেশ নারী ফুটবলের ভূয়সী প্রশংসা করে। সিনিয়রদের ঐতিহাসিক অর্জনের আনন্দের রেশ না কাটতেই ঘরের মাঠে অনূর্ধ্ব-২০ নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে অসাধারণ ফুটবল খেলে বাংলাদেশের মেয়েরা। টুর্নামেন্টে ছয় ম্যাচ খেলে প্রতিটিতে দাপট দেখিয়ে জিতে শিরোপা ঘরে তুলে তারা। এর পরপরই সামনে আসে আরেকটি এশিয়ান কাপের বাছাই পর্বের খেলা।
প্রথমবারের মতো অনূর্ধ্ব-২০ নারী এশিয়ান কাপের মূল পর্বে ওঠার ইতিহাস রচনা করে তৃষ্ণা রানী, সাগরিকারা। লাওসে বাছাই পর্বে স্বাগতিক লাওসকে ৩-১ গোলে হারিয়ে বাছাই পর্বের মিশন শুরু করে মেয়েরা। এরপর তিমুর লেস্তেকে ৮-০ গোলে উড়িয়ে দেয় তারা। শেষ ম্যাচে এশিয়ান নারী ফুটবলের পরাশক্তি দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে ৬-১ গোলে হারলেও আগের দুটি জয়েই আগামী এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে ওঠার কৃতিত্ব দেখায় অনূর্ধ্ব-২০ নারী দল। অর্থাৎ গত আড়াই মাসে দেশের নারী ফুটবল ছিল সোনায় মোড়ানো দিন। অথচ বছরের শুরুতে দেশের নারী ফুটবলের অবস্থা ছিল টালমাটাল। ইংলিশ কোচ পিটার জেমস বাটলারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসেন জাতীয় দলের নারী ফুটবলাররা।
সংবাদ সম্মেলন করে বাটলারের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ তুলে ধরেন সাবিনা খাতুনরা। এই কোচকে না সরালে সবাই অবসরে যাওয়ার হুমকি দেন তারা। বাফুফের প্রধানের দূরদর্শিতায় এ সংকট কাটে। সমস্যার সমাধান হয়, টিকে যান কোচ বাটলার। এরপর তার সামনে একের পর এক নতুন চ্যালেঞ্জ আসতে থাকে। প্রতিটি চ্যালেঞ্জেই জিতলেন কোচ বাটলার। তবে নারী ফুটবলের ঐতিহাসিক অর্জন শুধু এ ইংলিশ কোচের একার কৃতিত্ব নয় বলে মনে করেন বাফুফে নারী উইংয়ের প্রধান মাহফুজ আক্তার কিরণ। তিনি বলেন, ‘শুধু পিটার বাটলার নয়, এত বছর ধরে আমরা যে ক্যাম্প করে আসছি, সেটাও।
সবারই অবদান আছে। আমি ভুলে যাব না আরেকটি নাম-পল স্মলি। তিনি কিন্তু বীজ বপন করেছিলেন। ২০১২ সাল থেকে আমরা মেয়েদের দীর্ঘ সময় অনুশীলনে রেখেছি, তখন থেকেই পল স্মলি আমাদের সঙ্গে ছিলেন। খেলোয়াড়দের তিনি গড়ে তুলেছেন। পলকে ধন্যবাদ দিতে চাই, আর তখনকার কোচ ছোটন ভাইকেও ধন্যবাদ জানাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘পিটার কিন্তু রেডিমেড সব (খেলোয়াড়) পেয়েছেন, তিনি কিছু তৈরি করেননি।
রেডিমেড জিনিস নিয়েই কাজ করছেন। তবে আমি তাকে ছোট করছি না, তার নানা ধরনের কৌশল দিয়ে তিনি শেখাচ্ছেন, এ জন্য অবশ্যই তার কৃতিত্ব আছে। কিছু খেলোয়াড় তৈরি করছেন, এটাও তার কৃতিত্ব। আসলে এটি একটি প্যাকেজ- সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা। দীর্ঘদিনের ধারাবাহিক ক্যাম্পেরই ফল নারী ফুটবলের এ সাফল্য।’ কিরণের মতে, নারী ফুটবলের সাফল্যের পেছনে বাফুফের বর্তমান সভাপতি তাবিথ আউয়াল ও সাবেক সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন