হিমালয় অভিযানে মাউন্ট আমা দাবলাম, ভাগীরথী-২, আইল্যান্ড পিক, থারপু চুলি ইত্যাদি দুর্দান্ত অভিযানের পর এবার দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে ২৫ সেপ্টেম্বর, নেপালের স্থানীয় সময় রাত ৩টায় পৃথিবীর অষ্টম উঁচু পর্বতশৃঙ্গ মানাসলুর শিখরে লাল-সবুজ পতাকা উত্তোলন করেন ‘অলটিটিউড হান্টার বিডি মাউন্টেনিয়ারিং’ ক্লাবের অ্যাডমিন এবং পর্বতারোহী তৌফিক আহমেদ তমাল। এরপর গতকাল মধ্যরাতে অভিযান শেষ করে বেজক্যাম্পে ফিরে এসে তিনি দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে ভাগ করেছেন তার অনুভূতি-অভিজ্ঞতাসহ নানা বিষয়। তুলে ধরেছেন আরফান হোসাইন রাফি
কেমন আছেন? বর্তমানে আপনার শারীরিক অবস্থা কেমন?
আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আমি কিছুক্ষণ আগেই বেজক্যাম্পে এসেছি। গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাত ৩টা পর্যন্ত মানাসলু আরোহণ অভিযান চলেছিল। অভিযান শেষ করে নেপালের সময় সকাল ১০টায় ক্যাম্প থ্রিতে নেমেছি। সেখানে শরীর একটু ক্লান্ত ছিল, কারণ আগের রাত ঘুম হয়নি। সেই কারণে একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় সময় কাটিয়েছি, কিছু গোছগাছ করেছি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর ঘুম আসেনি। তারপর বিকেল ৩টার দিকে আবার যাত্রা শুরু করি এবং কিছুক্ষণ আগে অবশেষে পর্বতের বেজক্যাম্পে নেমে আসতে সক্ষম হয়েছি।
দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে মানাসলুর শিখরে পৌঁছে আপনার অনুভূতি কেমন?
মানাসলুতে দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে পৌঁছতে পেরে অনুভূতি ভালোই ছিল। তবে এখানে একটা বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই, আমি চেয়েছিলাম মানাসলুর প্রকৃত চূড়ায়, অর্থাৎ সর্বোচ্চ চূড়ায় যেন বাংলাদেশিদের পা পড়ে। সেই লক্ষ্যেই ছিল আমার মানাসলু আরোহণ।
এই অর্জন কাকে বা কাদেরকে উৎসর্গ করতে চান?
আমরা যখন ছোটবেলা থেকে পাহাড়ে ঘুরতাম, তখন সেই ঘোরাঘুরি থেকেই কখন যেন স্বপ্নটা আস্তে আস্তে বড় হয়ে গেছে। আমি নিজেও ঠিক টের পাইনি। আমরা সবসময় দলবেঁধে ঘুরতাম; একসঙ্গে টিম নিয়ে সবুজ পাহাড়ে যেমন যেতাম, স্বপ্ন ছিল সবাইকে নিয়ে একদিন সাদা পাহাড়েও যাব। তাই আজ সবাইকে খুব মিস করছি। আমার মতো আমার টিমের সদস্যরাও যেন একদিন সেখানে যেতে পারে, এই কামনা করি। আর আমার এই অর্জন মূলত তাদেরকেই উৎসর্গ করা।
মানাসলু আরোহণের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
মানাসলু অভিজ্ঞতা অসাধারণ ছিল। তবে আমার ক্ষেত্রে সেটা একটু ভিন্নভাবে ঘটেছে। সাধারণত সবাই সারারাত অভিযান চালিয়ে ভোরে কিংবা সকাল ৮টা থেকে দশটার মধ্যে শীর্ষে পৌঁছায়, যাতে ভালো ভিউ উপভোগ করা যায়। কিন্তু আমার আসলে সেরকম কোনো লক্ষ্য ছিল না। আমার লক্ষ্য ছিল যত দ্রুত সম্ভব শীর্ষে পৌঁছানো। সেই কারণেই আমরা দ্রুততম সময়ে আরোহণ শেষ করে নিচে নেমে আসার চেষ্টা করেছি। তাই আমরা রাতেই আরোহণ করেছি, আর ২৫ সেপ্টেম্বরের রাতটি ছিল সবচেয়ে অনুকূল আবহাওয়ার রাত। এই অভিযানে আমি পর্বতের চারপাশে তিনবার ঘুরতে পেরেছি। সেই সময় থেকেই পর্বতের প্রতি এক অমোঘ টান অনুভব করেছি। এর সৌন্দর্য সত্যিই অসাধারণ। এটি একটি পিরামিড-আকৃতির পর্বত। এই পর্বতের আশপাশের প্রতিটি গ্রাম থেকেও মানাসলুর ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধরা দেয়। তবে ভয়াবহতার দিক থেকেও মানাসলু উল্লেখযোগ্য। অতীতে এখানে মৃত্যুহার ছিল অনেক বেশি। সেই কারণেই নেপাল সরকার প্রকৃত শীর্ষে ওঠার পথ বন্ধ করে দিয়েছে এবং যতটুকু পর্যন্ত নিরাপদ, সেটুকুকেই অনুমোদিত শীর্ষবিন্দু হিসেবে নির্ধারণ করেছে।
অভিযানের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্ত কোনটি ছিল?
প্রতিটি অভিযানের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্ত আসলে আর্থিক বাধা। সেই সব বাধা অতিক্রম করেই মানাসলু অভিযান সফল করতে পেরেছি, এটাই আমার জন্য সবচেয়ে আনন্দের বিষয়।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
ভবিষ্যতে হিমালয়ের আরও কিছু উল্লেখযোগ্য পর্বত আরোহণ করতে চাই। তার পাশাপাশি আন্দিজ পর্বতমালায়ও কিছু অভিযান করার ইচ্ছা আছে। আমি পৃথিবীর সাতটি উপ-মহাদেশের সর্বোচ্চ সাতটি পর্বতশৃঙ্গ স্পর্শ করতে চাই। এ ছাড়া যেহেতু মানাসলু অভিযানটি সফলভাবে শেষ হয়েছে তাই আশা করছি, আগামী এপ্রিল-মে, অর্থাৎ স্প্রিং সিজনে এভারেস্ট অভিযানে অংশ নিতে পারব।
দেশের পতাকা সর্বোচ্চ চূড়ায় তোলার স্বপ্নটা কবে থেকে শুরু হয়েছিল?
হয়তো বান্দরবান থেকেই। শুরুতে দেশে আমি যা করতাম, তা হলো দেশের সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গের উচ্চতা মাপা এবং সেখানে দেশের পতাকা তুলে ধরা। সেখান থেকেই আসলে স্বপ্নটা বড় হতে শুরু করে, আর ধীরে ধীরে সেই স্বপ্ন আমাকে হিমালয়ের দিকে টেনে নিয়ে যায়।
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য আপনার বার্তা কী হবে?
তরুণ প্রজন্মের জন্য আমার বার্তা হবেÑ পর্বতারোহণ একটি স্বাস্থ্যসম্মত খেলা। আমরা নানা সময়ে বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার সঙ্গে যুক্ত থাকি, তবে এই খেলায় শারীরিকভাবে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। একই সঙ্গে মানসিক চাপও সামলাতে হয়, যা মানুষকে ভবিষ্যতে আরও দৃঢ় ও পরিশ্রমী হতে সাহায্য করে। তাই তরুণ প্রজন্মের প্রতি আমার আহ্বান, সময়ে-অসময়ে ভ্রমণ করা উচিত এবং প্রকৃতির কাছাকাছি আসা উচিত।
নিজেকে নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী?
আমার স্বপ্ন হলো, যতদিন আমি বেঁচে থাকব, পাহাড়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখা। সেই সম্পর্ক থেকেই মানুষকে পাহাড়ে নিয়ে যাওয়া, তাদের ঘুরিয়ে আনা এবং ভ্রমণটাকে আরও আনন্দদায়ক ও সুন্দর করে তোলাটাই আমার স্বপ্ন।