ঢাকা মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২৫

জুলাই-আগস্ট গণহত্যা

গণহত্যার দায়ে হাসিনার মৃত্যুদণ্ড 

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৮, ২০২৫, ১২:১২ এএম

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দোর্দ- প্রতাপে দেড় দশক দেশ শাসন করা ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৃত্যুদ- দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এ ছাড়া সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদ- দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির অপরাধ প্রমাণিত। তিনটি অভিযোগে শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদ- দেওয়া হয়েছে। একটি অভিযোগে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকেও মৃত্যুদ- দেওয়া হয়েছে। অ্যাপ্রুভার (রাজসাক্ষী) হওয়ায় পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক  (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদ- দেওয়া হয়েছে। 

গতকাল সোমবার বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ এ রায় ঘোষণা করেন। এ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেনÑ বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। গণঅভ্যুত্থানের সময় অন্তত ১৪০০ হত্যাকা-সহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় করা এটিই প্রথম মামলার রায়। শেখ হাসিনাই বাংলাদেশের প্রথম সাবেক সরকারপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রী, যার মাথার ওপর ঝুলল মৃত্যুদ-ের খাঁড়া।

গতকাল দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটের দিকে ছয় অধ্যায়ে ৪৫৩ পৃষ্ঠার রায়ের প্রথম অংশ পড়া শুরু করেন বিচারিক প্যানেলের সদস্য বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলের অপর সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ। ২ ঘণ্টা ১০ মিনিটের সংক্ষিপ্ত রায় পড়া শেষে দুপুর ২টা ৫০ মিনিটে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে এ রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল।

গতকাল সেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকেই শেখ হাসিনার সর্বোচ্চ সাজার রায় এলো, যে আদালত তার সরকার গঠন করেছিল একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য। এই ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদ-ের রায়ের ভিত্তিতেই আওয়ামী লীগের আমলে জামায়াতে ইসলামীর পাঁচ শীর্ষ নেতা এবং বিএনপির একজনের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছিল।

সরকারি চাকরির কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সরকারের পদত্যাগের এক দফার রূপ নেওয়ার পর ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে; হেলিকপ্টারে চড়ে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এরপর তার বিরুদ্ধে কয়েকশ মামলা হয় দেশের বিভিন্ন আদালত ও থানায়। আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকর্মীকে সেসব মামলায় আসামি করা হয়। এর মধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জুলাই হত্যাকা-ের বিচারের উদ্যোগ নেয়।

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের ঘটনা সারা বিশ্বের নজর কেড়েছিল। ফলে গতকাল তার রায়ের দিনে পুরো বাংলাদেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর নজর ছিল ট্রাইব্যুনালের দিকে। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এ মামলার রায় ঘোষণার কার্যক্রম আদালত থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।

হাসিনা-কামাল-মামুন :

কোন অপরাধে কার কী সাজা :

জুলাই অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যে পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, তার মধ্যে তিনটিতে মৃত্যুদ-ের সাজা দিয়েছেন আদালত। মামলার আরেক আসামি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের মৃত্যুদ- হয়েছে চানখাঁরপুল ও আশুলিয়ার দুটি ঘটনায়। এই দুই ঘটনায় দায় থাকায় পাঁচ বছরের সাজা হয়েছে মামলার তৃতীয় আসামি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের।

শেখ হাসিনা :

এক নম্বর অভিযোগের ‘প্ররোচনা, হত্যার নির্দেশ এবং বলপ্রয়োগ থামাতে ব্যর্থতার’ দায়ে আমৃত্যু কারাদ- হয় সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীর। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দ্বিতীয়, চতুর্থ এবং পঞ্চম অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তিন অভিযোগে একসঙ্গে মৃত্যুদ-ের রায় দেওয়া হয়। রায়ে বলা হয়, দ্বিতীয় অভিযোগের ক্ষেত্রে ড্রোন, হেলিকপ্টার এবং প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশদাতা হিসেবে অভিযোগ প্রমাণ হয়েছে।

চতুর্থ অভিযোগে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট ঢাকার চানখাঁরপুলে ছয়জন ‘নিরস্ত্র আন্দোলনকারীর’ গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর ঘটনায় সম্পৃক্ততার জন্য দায়ি করা হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে। পঞ্চম অভিযোগে ছিল, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আশুলিয়ায় ছয় ছাত্র আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা, যাদের মধ্যে পাঁচজনকে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং ষষ্ঠজনকে জীবিত অবস্থায় আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রমাণ হয়েছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে।

আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল :

চানখাঁরপুলে ছয়জন নিরস্ত্র আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যায় সহযোগিতা ও তা প্রতিরোধে ব্যর্থতা এবং পঞ্চম অভিযোগের আশুলিয়ায় পাঁচজনকে গুলি করে হত্যার পর পুড়িয়ে ফেলায় সহযোগিতা ও তা প্রতিরোধে ব্যর্থতায় দায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালকে মৃত্যুদ- দেন আদালত

রায়ে প্রমাণ হয়েছে, অপরাধী যত ক্ষমতাশালী হোক সে আইনের ঊর্ধ্বে নয় চিফ প্রসিকিউটর :

ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলি (চিফ প্রসিকিউটর) মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আমরা মনে করি, এই রায়টি কোনো ধরনের অতীতের প্রতিশোধ নয়। এটি হচ্ছে জাতির প্রতিজ্ঞা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য। এটা হচ্ছে জাতির কোয়েস্ট ফর জাস্টিস। এই রায় প্রমাণ করেছে- অপরাধী যত বড় হোক, যত ক্ষমতাশালী হোক সে আইনের ঊর্ধ্বে নয় এবং বাংলাদেশ এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে যত বড় অপরাধীই হোক, তার অপরাধের জন্য তাকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে এবং তার প্রাপ্য শাস্তি পেতে হবে।’

তাজুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশে যে ১৪০০ তরতাজা তরুণ প্রাণ এই স্বৈরশাসনের অবসানের জন্য জীবন দিয়েছেন, তাদের পরিবারে যদি সামান্য একটু স্বস্তি আসে, সেটিই আজকের এই প্রসিকিউশনের প্রাপ্তি। জাতির পক্ষে আমরা একটা বিচারিক প্রক্রিয়াকে সম্পন্ন করার মাধ্যমে এই জাতিকে বিচারহীনতার কলঙ্ক থেকে মুক্ত করার যে ক্ষুদ্র আমাদের প্রয়াস, সেটা যদি সফল হয় সেখানেই আমাদের সাফল্য।’ আন্তর্জাতিক মানদ- মেনে এ বিচারের রায় হয়েছে দাবি করে তাজুল বলেন, ‘আমরা এটাও একই সঙ্গে বলতে চাই, যে কোয়ালিটি অব এভিডেন্স এখানে দেখানো হয়েছে, যে ধরনের সাক্ষ্যপ্রমাণ এই আদালতে উপস্থাপিত হয়েছে, বিশ্বের যেকোনো আদালতের স্ট্যান্ডার্ডে এই সাক্ষ্যপ্রমাণগুলো উত্তীর্ণ হয়ে যাবে এবং পৃথিবীর যেকোনো আদালতে এই সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপন করা হলে আজকে যেসব আসামিকে শাস্তি প্রদান করা হয়েছে তারা প্রত্যেকেই সেই শাস্তি পাবেন।’

ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের প্রতি মাইলফলক হয়ে থাকবে-অ্যাটর্নি জেনারেল :

অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা মনে করি, শহিদদের প্রতি, দেশের প্রতি, এ দেশের মানুষের প্রতি, গণতন্ত্রের প্রতি সংবিধানের প্রতি, আইনের শাসনের প্রতি আগামী প্রজন্মের প্রতি দায়বদ্ধতা পরিশোধের স্বার্থে এ রায় একটি যুগান্তকারী রায়। এ রায় প্রশান্তি আনবে, ভবিষ্যতের প্রতি একটা বার্তা, বাংলাদেশের ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের প্রতি মাইলফলক হয়ে থাকবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ মামলার মধ্যে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের ইস্যু ছিল না বলে ওই বিষয়ে তারা (ট্রাইব্যুনাল) কোনো কমেন্টস করেননি। শেখ হাসিনা এবং আসাদুজ্জামান খান কামালের বাংলাদেশের সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ রায় বাস্তবায়ন কীভাবে হবে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘রায় বাস্তবায়ন আইনি পথেই, আইনসঙ্গতভাবেই হবে। বেআইনি বা আইনসঙ্গত নয়Ñ এমন পথ সরকার অবলম্বন করবে না।’

আসামিদের ফাঁসির রায়ে আমি কষ্ট পেয়েছি- রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী : আদালতের দৃষ্টিতে পলাতক শেখ হাসিনা এ মামলার শুনানিতে সরাসরি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাননি। তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জুলাই হত্যাকা-ের নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ট্রাইব্যুনালের শুনানিতে তার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেনও তাকে নির্দোষ দাবি করেছিলেন। রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আমির হোসেন বলেন, ‘রায়টা আমার পক্ষে হয়নি, বিপক্ষে গেছে। এ জন্য আমি ক্ষুব্ধ। কষ্ট লালন করতেছি। আসামিদের ফাঁসির রায়ে আমি কষ্ট পেয়েছি।’

সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে শহিদ পরিবার ও আহতদের দেওয়ার আদেশ: জুলাই গণঅভ্যুত্থান দমনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের মৃত্যুদ-ের আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে এই দুই আসামির সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে সেই অর্থ জুলাই শহিদ পরিবার ও আহতদের দেওয়ার জন্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক। 

আত্মসমর্পণ-গ্রেপ্তার না হলে আপিলের সুযোগ নেই হাসিনা-কামালের : শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদ- দিলেও এই রায়ের বিরুদ্ধে তাদের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিলের সুযোগ রয়েছে তাদের। তবে এ জন্য তাদের গ্রেপ্তার হতে হবে বা আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হবে। তাদের পক্ষে নিযুক্ত রাষ্ট্র নিয়োজিত আইনজীবী আমির হোসেন এ কথা জানিয়েছেন। রায়ের পর ব্রিফিংয়ে রাষ্ট্রনিযুক্ত আসামিপক্ষের আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, ‘আমার ক্লায়েন্টরা সারেন্ডার বা গ্রেপ্তার না হলে আমার পক্ষে এ মামলায় আপিল করার সুযোগ নেই। আপনারা দেখেছেন, আমাকে রায়ের কপিও দেবেন না, মাননীয় ট্রাইব্যুনাল বলেছেন।’

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে পেল গুরুত্ব :

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফাঁসির রায় ঘোষণার খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও গুরুত্ব পেয়েছে। এ রায়কে গুরুত্ব দিয়ে দেশি গণমাধ্যমের পাশাপাশি খবর প্রকাশিত হয়েছেÑ বার্তা সংস্থা রয়টার্স, এএফপি, বিবিসি, সিএনএন, আলজাজিরা, গার্ডিয়ানসহ অনেক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। বিবিসি, আল-জাজিরা এবং ভারতের বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম এই রায়ের খবর সরাসরি প্রচারও করেছে।

বিবিসির খবরের শিরোনাম করা হয় ‘নৃশংসভাবে বিক্ষোভ দমনের মামলায় বাংলাদেশের সাবেক নেতা শেখ হাসিনার মৃত্যুদ-’। রয়টার্সের খবরের শিরোনাম ছিলÑ ‘শিক্ষার্থীদের ওপর দমন-পীড়নের দায়ে বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী হাসিনার মৃত্যুদ-’। বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনের শিরোনামÑ ‘মানবতাবিরোধী অপরাধে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুদ-’। আল-জাজিরার লাইভের শিরোনাম ছিলÑ ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বাংলাদেশের হাসিনার মৃত্যুদ-’। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম সিএনএনের শিরোনামÑ ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত নেত্রী শেখ হাসিনার মৃত্যুদ-’। এ ছাড়া ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ক্ষমতাচ্যুত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৃত্যুদ-’ শিরোনামে প্রতিবেদন করেছে যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান। এদিকে ভারতের গণমাধ্যম দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের শিরোনাম ছিল ‘শেখ হাসিনার মৃত্যুদ-: এখন কী হবে’। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনৈতিক শত্রুদের তাড়া করতে ২০০৯ সালে তিনি নিজেই যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিলেন, সেটাই তার মৃত্যুদ-ের আদেশ দিয়েছেন।

ভারতের আরেক গণমাধ্যম দ্য হিন্দুর লাইভের শিরোনাম ছিল ‘ছাত্র দমন-পীড়নের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক মন্ত্রী কামালের মৃত্যুদ-’। এ ছাড়া পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম ডনের প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিলÑ ‘ছাত্রদের ওপর দমন-পীড়নের দায়ে বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৃত্যুদ-’। 

বিয়ে বার্ষিকীর দিন মৃত্যুদ-াদেশ পেলেন হাসিনা :

শেখ হাসিনা যেদিন মৃত্যুদ-াদেশ পেলেন, দুর্ভাগ্যবশত এদিন ছিল তার ৫৮তম বিয়েবার্ষিকী। ১৯৬৭ সালে শেখ মুজিবের কারাগারে থাকা অবস্থায় মা ফজিলাতুন নেছার তত্ত্বাবধানে  বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে বিয়ে হয় শেখ হাসিনার। 

এ দম্পতির বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা কিছুটা তড়িঘড়ি করেই করেছিলেন ফজিলাতুন নেছা। শেখ হাসিনা ও এম এ ওয়াজেদ মিয়া দম্পতির সংসারে সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুল নামে দুই সন্তান রয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের জন্ম ১৯৭২ সালের ৯ ডিসেম্বর।

হাসিনার মৃত্যুদণ্ডে উচ্ছ্বাস, সেজদা ও মোনাজাত :

জুলাই গণঅভ্যুত্থান দমানোর চেষ্টায় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের দায়ে শেখ হাসিনাকে প্রাণদ-ের রায়ের পর হাইকোর্টের সামনে উপস্থিত জনতাকে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়তে দেখা গেছে। সে সময় ‘এই মাত্র খবর এলো, খুনি হাসিনার ফাঁসি হলো’ স্লোগান দিতে দিতে তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরেন। রায় ঘোষণার পরপরই ‘মঞ্চ ২৪’ নামের ব্যানারে একদল ছাত্র-জনতাকে হাই কোর্টের সামনেই সেজদা দিয়ে ও মোনাজাত করে সন্তুষ্টি প্রকাশ করতে দেখা যায়। 

ট্রাইব্যুনালের গেটের সামনে মিষ্টি বিতরণ :

এদিকে শেখ হাসিনার মৃত্যুদ-ের রায়ের খবর পাওয়া মাত্র আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ফটকের সামনে উল্লাস শুরু করেন বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ। তাদের মধ্যে ছিলেন জুলাই শহিদ পরিবারের কয়েকজন সদস্য ও আহতরা। গতকাল বেলা পৌনে তিনটার দিকে রায় আসার পর ট্রাইব্যুনালের ফটকের সামনে উল্লাস শুরু হয়। উপস্থিত লোকজন বিভিন্ন স্লোগান দেন। এর মধ্যে ছিল ‘এই মুহূর্তে খবর এলো, খুনি হাসিনার ফাঁসি হলো’, ‘চব্বিশের বাংলায়, খুনি হাসিনার ঠাঁই নাই’।

বিকেল তিনটার দিকে সেখানে মিষ্টি বিতরণ করা হয়। এখানে উপস্থিত ছিলেন শহিদ ইসমাইল হোসেন রাব্বির বাবা মিরাজ তালুকদার। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনা যে অপরাধ করেছেন, ১০০ বার ফাঁসি দিলেও সেটা কম হয়ে যাবে। হাসিনার ফাঁসির রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। এই রায় দ্রুত কার্যকর দেখতে চাই।’

সিলেট ও কেরানীগঞ্জে মিষ্টি বিতরণ:

এদিকে শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের মৃত্যুদ-ের রায় ঘোষণার পর সিলেট ও ঢাকার কেরানীগঞ্জে মিষ্টি বিতরণ ও আনন্দ মিছিল হয়েছে। এই রায় ঘিরে গতকাল সকাল থেকে সিলেট নগরের চৌহাট্টা এলাকার কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার এলাকায় অবস্থান নেন সিলেটের এনসিপির নেতারা। রায় ঘোষণার পর নগরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে মিষ্টি বিতরণ হয়।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় প্রথম মামলাটি হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। গত বছরের ১৭ অক্টোবর পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালের প্রথম বিচারকাজ অনুষ্ঠিত হয়। সেদিনই এ মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল।

প্রথমদিকে এ মামলায় শেখ হাসিনাই একমাত্র আসামি ছিলেন। চলতি বছরের ১৬ মার্চ এ মামলায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে আসামি করার আবেদন করে প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ)। ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করেন। একাধিকবার সময় বাড়ানোর পর চলতি বছরের ১২ মে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। গত ১ জুন শেখ হাসিনাসহ এই তিন আসামির বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করে প্রসিকিউশন। আনুষ্ঠানিক অভিযোগে এই তিন আসামির বিরুদ্ধে মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়।

অভিযোগগুলো হলোÑ গত বছরের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান, হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে নির্মূল করার নির্দেশ প্রদান, রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা, রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ছয় আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা এবং আশুলিয়ায় ছয়জনকে পোড়ানোর অভিযোগ। এই পাঁচ অভিযোগে তিনজনের বিরুদ্ধে গত ১০ জুলাই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান পলাতক। সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এ মামলার একমাত্র গ্রেপ্তার।

আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের দিন গত ১০ জুলাই সাবেক আইজিপি মামুন গণঅভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হওয়ার আবেদন করেন। গত ১২ অক্টোবর এ মামলায় যুক্তিতর্ক শুরু হয়। যুক্তিতর্ক শেষ হয় ২৩ অক্টোবর। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের মৃত্যুদ- চান চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামানের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। তিনি যুক্তিতর্কে এ মামলা থেকে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামানের খালাস আবেদন করেন। রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি মামুনেরও খালাস আবেদন করেন তার আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।