ঢাকা মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২৫

যেভাবে ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠেন শেখ হাসিনা

মেহেদী হাসান খাজা
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৮, ২০২৫, ১২:১৭ এএম

অন্যের জন্য কবর খুঁড়লে নিজেকেই সেই কবরে পড়তে হয়। প্রবাদটি ২০২৪ সালের আগস্টে ক্ষমতাচ্যুত বাংলাদেশের স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে আবারও সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনামলে তার সরকার উন্নত নজরদারি প্রযুক্তি, বিশেষ করে পেগাসাসের মতো স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, সাংবাদিক ও সমালোচকদের ফোনে আড়ি পেতে নজরদারিতে রাখত।

২০২৪ সালের জুলাই মাসের শিক্ষার্থী নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের সময় শেখ হাসিনার কার্যকলাপের ওপর সেই একই নজরদারিব্যবস্থা তার বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হয়েছে। ফাঁস হওয়া তার ফোনালাপগুলো তারই বিরুদ্ধে চলমান মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে যুক্ত হয়।

গণঅভ্যুত্থান দমনে হাসিনা মোবাইল ফোনে বিভিন্ন সময় নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তার সেই কথোপকথনই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে তার ফোনে আড়ি পেতে ধারণ করা হয়। উন্নত প্রযুক্তির যে যন্ত্র ব্যবহার করে এসব করা হয়েছে, হাসিনার সরকারই তা বিদেশ থেকে এনেছে। এই যন্ত্রটি ব্যবহার করে ফ্যাসিস্ট আমলে বিরোধী দলের সদস্যসহ সরকারবিরোধী অনেকের মোবাইল ফোনের কথোপকথন ফাঁস হয়েছে। সেই যন্ত্রটি ব্যবহার করেই হাসিনার আন্দোলন দমনের কৌশল আড়ি পেতে শুনেছিল ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)।

ফাঁস হওয়া ফোনালাপ থেকে জানা যায়, হাসিনা জঙ্গি তকমা লাগিয়ে গণঅভ্যুত্থান দমনের কথা বলেছেন। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। ড্রোন দিয়ে অবস্থান শনাক্ত করে হেলিকপ্টার দিয়ে ওপর থেকে গুলি করাচ্ছেন। যাকে যেখানে পাওয়া যাবে সোজা গুলি করবেÑ এমন নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন, রাজাকারদের মতো আন্দোলনকারীদের ফাঁসি দেওয়া হবে।

গত ২৪ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাসিনার ফোনালাপগুলো গণহত্যায় তার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। ট্রাইব্যুনালে হাসিনার যেসব ফোনালাপ শোনানো হয়, সেগুলোকে মামলার ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করে প্রসিকিউশন।

আদালতে তিনজনের সঙ্গে হাসিনার চারটি কথোপকথনের রেকর্ড বাজিয়ে শোনানো হয়। হাসিনা গণঅভ্যুত্থান চলাকালে ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এস এম মাকসুদ কামাল ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। তখন তারা আন্দোলন দমনে বিভিন্ন কর্মকৌশল সম্পর্কে কথা বলেন। যেমনÑ আন্দোলনকারীদের অবস্থান ড্রোনের মাধ্যমে নির্ণয় করে, হেলিকপ্টার থেকে গুলি, প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার, আন্দোলনকারীদের তালিকা করে পাকড়াও করা। এ ছাড়া, রাজাকার আখ্যা দিয়ে মেরে ফেলা, ছত্রীসেনা নামিয়ে বোম্বিং করা, ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করা, আগুন লাগানো, জঙ্গি ট্যাগ দিয়ে প্রচারসহ আরও অন্যান্য নির্দেশনা দিয়েছেন হাসিনা।

বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা, প্রসিকিউটর তানভীর হাসান জোহা সে সময় জানান, এ রকম ৬৯টি কথোপকথন গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর প্রসিকিউশনের হাতে আসে। তদন্তের সময় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জোহা বিটিআরসি, এনটিএমসি, ডিএমপিসহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তর থেকে বিভিন্ন অডিও ক্লিপ, ভিডিও ফুটেজ, সিডিআর, আইপিডিআর, সিসি ক্যামেরা ফুটেজসহ ডিজিটাল ফরেনসিক বিষয় সংগ্রহ করেছেন।

যেভাবে ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠেন এক সময়ের গণআন্দোলনের নেত্রী ও আ.লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা : ছাত্রজনতার গণআন্দোলনের মুখে চব্বিশের ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন টানা ১৬ বছর ক্ষমতা আঁকড়ে ধরা শেখ হাসিনা। অবস্থা বেগতিক দেখে সেদিন হাসিনা ও তার বোন রেহানা সামরিক হেলিকপ্টারে ওঠেন। দুপুর আড়াইটায় ভারতের উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়েন তারা। তার পালিয়ে যাওয়ার খবর নিশ্চিত হওয়ার পরই প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে ঢেউ নামে ছাত্র-জনতার। ‘বাংলাদেশের দ্বিতীয় বিজয়’ উদযাপন করেন সাধারণ মানুষ। ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। তার পিতা বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং মাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তিনি পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়।

১৯৭৫ সালে তিন ছেলে, পুত্রবধূ ও স্ত্রীসহ সপরিবারে শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর বেশ কয়েক বছর জার্মানি ও ভারতে নির্বাসিত জীবন কাটিয়েছেন প্রাণে বেঁচে যাওয়া দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। এরপর ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের সভাপতি হন শেখ হাসিনা। ১৯৯০-এ দেশে গণতান্ত্রিক যাত্রা শুরু হলে ১৯৯১-এর সাধারণ নির্বাচনে দলের নেতৃত্ব দেন তিনি। কিন্তু খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপির কাছে তার দল অপ্রত্যাশিতভাবে হেরে যায়। পাঁচ বছর বিরোধী দলে থাকার পর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিএনপিকে হারিয়ে জয়ী হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। প্রথমবারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। এরপর ২০০০ সালের নির্বাচনে তিনি ফের বিরোধীদলীয় নেত্রী হন। ২০০৬ সালে বিএনপির মেয়াদ শেষ হয়। ওই বছরের ২৯ অক্টোবর বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সে সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হলে একপর্যায়ে প্রধান উপদেষ্টাসহ সব উপদেষ্টা পদত্যাগ করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দীন আহমদকে নতুন প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। 

২০০৯ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হওয়ার পর হাসিনা ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টা করতে থাকেন। প্রথমেই বাতিল করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। শুরু করেন বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন।  ক্ষমতাও দীর্ঘায়িত করার সব প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন তিনি। সে সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের বিরুদ্ধে রাজপথে সোচ্চার হয় বিএনপি। সারা দেশে হরতাল-অবরোধসহ তীব্র আন্দোলনেও সিদ্ধান্ত থেকে সরানো যায়নি বজ্রকঠিন শেখ হাসিনাকে।

এরপর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের ১৫৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন। বাকি ১৪৭টিতে একযোগে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্তির প্রতিবাদে দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০০টির মধ্যে ২৩৪টি আসনে বিজয়ী হয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। ২০১৪ সালের ৯ জানুয়ারি দলের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফের শপথগ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে ক্ষমতাসীন দলের একচ্ছত্র আধিপত্য, প্রশাসনে ব্যাপক দলীয়করণ ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ের কারণে বিএনপি মাঠেই দাঁড়াতে পারেনি। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সে নির্বাচনে ভোট কারচুপি ও রাতে ব্যালটে সিল মারারও অভিযোগ ওঠে। প্রহসনের ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ফের নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। শেখ হাসিনা আবারও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করেন।

এরপর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফের অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে ২৯৯টি আসনের মধ্যে ২২৩টি আসন পেয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ফের নিরঙ্কুশ জয় পায়। জাতীয় পার্টি ও বেশ কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী এ নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তোলে। ৯ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ভোটের ফলের গেজেট প্রকাশ করা হয়। টানা চতুর্থবার ও পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার টানা ১৬ বছরের শাসনামলে দেশে শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে উচ্চ বেকারত্বের হার বাড়ছিল। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটাব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন। প্রথমে ২০১৮ সালে কোটা বিলুপ্তির দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাজপথে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলেন। সে সময় শেখ হাসিনা ছাত্রদের এ অধিকার আন্দোলনকে দমন করতে সফল হলেও, একই দাবিতে চব্বিশের আন্দোলন মোকাবিলা করতে তিনি পুরোপুরি ব্যর্থ হন। চব্বিশের জুলাইয়ের প্রথমদিকে সংঘটিত ওই আন্দোলন দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেন হাসিনা। পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়, যখন আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের বংশধর’ বলে গাল দেন। পর্যায়ক্রমে কোটা সংস্কার আন্দোলন রূপ নেয় সরকার পতনের আন্দোলনে।

একই বছরের ২১ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট সরকারি চাকরি থেকে কোটাব্যবস্থা প্রায় পুরোপুরি তুলে দেন। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে শত শত বিক্ষোভকারী প্রাণ হারান। দফায় দফায় আন্দোলন আরও তীব্র হতে থাকে। বিক্ষোভকারীদের ওপর নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন চালানোর খেসারত দিতে হয়েছে হাসিনাকে। একপর্যায়ে ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালাতে বাধ্য হন তিনি।

শেখ হাসিনা কেন নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক হয়ে দাঁড়ালেন? 

প্রশ্ন হলো, শেখ হাসিনা কেন নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক হয়ে দাঁড়ালেন? জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপিং ইকোনমিকসের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট মায়ুমি মুরায়ামা বলেন, ‘১৯৯৬ সালে হাসিনা প্রথম যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন তাকে একজন কর্তৃত্ববাদী রাজনীতিক হিসেবে প্রাথমিকভাবে আমার মনে হয়নি।’ দুই বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল শেষে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফেরার পর তিনি কর্তৃত্ববাদের দিকে ঝুঁকে পড়তে থাকেন বলে ইঙ্গিত দেন মায়ুমি। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেই শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে তথাকথিত দুর্নীতির মামলায় বিচারের মুখোমুখি করেন। তাকে কারাদ- দেওয়া হয়। দুর্বল হয় বিএনপি। তবু কর্তৃত্ববাদী আচরণ ও বিরোধীদের দমন করা থেকে এতটুকুও দমানো যায়নি তাকে। তিনি তার বাবা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘দেবতাতুল্য’ করে তোলার চেষ্টা ত্বরান্বিত করেন এবং সরকারের সমালোচনা সহ্য করা যায় না, এমন এক পরিবেশ তৈরি করেন।

দেশের মুসলিম নেতাদের প্রতি দমন-পীড়নের মাত্রাও দিন দিন বাড়িয়ে দেন শেখ হাসিনা। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এনে দেশের প্রধান ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর দলীয় নিবন্ধন বাতিল করা হয়। হাসিনার শাসনামলে ভয়ে তটস্থ অনেকেই নীরব থাকলেও, যারাই আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সমালোচনা করতেন, তাদের জেল, জুলুম, গুম, নির্যাতন সহ্য করতে হতো। নির্যাতন থেকে বাদ যায়নি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও ইসলামি ব্যক্তিত্ব। গণমাধ্যম ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপরও খড়্গহস্ত হন হাসিনা।

হাসিনার শাসনামল এবং ডিজিটাল নজরদারির উত্থান : ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ব্যাপকভাবে ডিজিটাল নজরদারির ওপর নির্ভর করে মতপ্রকাশ ও বিরোধিতা দমন করে। এ সময় বিদেশ থেকে নানা ধরনের নজরদারি প্রযুক্তি কেনা হয়। ইসরায়েলের সঙ্গে সরকারি কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে সেই দেশ থেকে স্পাইটেক সংগ্রহের অভিযোগ ওঠে। ২০১৫ সালের পর কমপক্ষে ১৯০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে এসব প্রযুক্তি কেনা হয়। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের অধীন ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) নজরদারি ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। ফোন, ডেটা ও যোগাযোগ আটকানো এবং বিশ্লেষণের দায়িত্ব তাদের ওপরই ছিল। সবচেয়ে আলোচিত প্রযুক্তি ছিল এনএসও গ্রুপের তৈরি পেগাসাস। এই স্পাইওয়্যার ফোনে সংক্রমিত হয়ে গোপনে ডেটা নেয়, কথোপকথন রেকর্ড করে এবং অবস্থান অনুসরণ করে। ২০২১ সালের ‘পেগাসাস প্রজেক্ট’-এর বিশ্বব্যাপী তদন্তে বাংলাদেশকে এই প্রযুক্তির সম্ভাব্য ব্যবহারকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিরোধী নেতা, সাংবাদিক ও অধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে এটি ব্যবহৃত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরও মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে প্রায় ১২ মিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের অনুরূপ ইসরায়েলি প্রযুক্তি আনা হয় বলে তথ্য রয়েছে। এসব সক্ষমতা এনটিএমসি-র মাধ্যমে সমন্বিত হয়ে দেশজুড়ে একধরনের ‘ডিজিটাল পুলিশি রাষ্ট্র’ সৃষ্টি করে, যা বিরোধীদের বিরুদ্ধে কথোপকথন ফাঁস, গ্রেপ্তার ও দমনকে আরও সহজ করে তোলে। কিন্তু শেষে নিজের খোঁড়া সেই কবরেই পড়েন শেখ হাসিনা।

২০২৪-এর আন্দোলন ও পরিস্থিতির মোড় ঘোরা :  ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কার দাবির আন্দোলন দ্রুতই দেশব্যাপী সরকারবিরোধী গণআন্দোলনে রূপ নেয়। কঠোর দমনে প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন নিহত হয়। চাপে পড়ে শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট ২০২৪ ভারতে পালিয়ে যান।