ঢাকা মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২৫

শেখ হাসিনাকে আদৌ ফেরত দেবে ভারত?

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৮, ২০২৫, ১২:১৫ এএম

২০২৪ সালের জুলাইয়ে গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গতকাল সোমবার বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এই রায় দেন। রায় ঘোষণার পরপরই ভারতে অবস্থানরত ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে হস্তান্তরের জন্য নয়াদিল্লির প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ঢাকা। এরপর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে শেখ হাসিনার রায়ের বিষয় সম্পর্কে অবগত হিসেবে জানালেও তাকে ফেরত দেওয়ার বিষয়ে কিছু বলেনি। এমনকি রায়ের বিষয়ে সরাসরি কোনো প্রতিক্রিয়াও দেয়নি। বরং উভয় দেশের সম্পর্ক ও জনগণের স্বার্থের দিকটি প্রাধান্য পেয়েছে বিবৃতিতে।

এদিকে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের ফাঁসির রায় হলেও আদৌ তাদের ভারত ফেরত পাঠাবে কি নাÑ এ নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। যদিও এর আগে ঢাকা থেকে বারবার শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর জন্য চিঠি দেওয়া হলেও তার কোনো কর্ণপাত করেনি ভারত। ফাঁসির রায়ের থেকে তাদের দেশে ফেরানো ইস্যুতে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণকরা করছেন নানা চুলচেরা বিশ্লেষণ। গতকাল সোমবার এ বিষয়টি ছিল ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’ । ফাঁসির রায়ের পর গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আজকের রায়ে পলাতক আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল জুলাই হত্যাকা-ের জন্য অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছেন এবং দ-প্রাপ্ত হয়েছেন। মানবতাবিরোধী অপরাধে দ-প্রাপ্ত এই ব্যক্তিদের দ্বিতীয় কোনো দেশ আশ্রয় দিলে তা হবে অত্যন্ত অবন্ধুসুলভ আচরণ এবং ন্যায়বিচারের প্রতি অবজ্ঞার শামিল।’

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও বলছে, ‘আমরা ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই, তারা যেন অনতিবিলম্বে দ-প্রাপ্ত এই দুই ব্যক্তিকে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে। দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুসারে এটি ভারতের জন্য অবশ্য পালনীয় দায়িত্বও বটে।’

এদিকে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে আবারও ভারতের কাছে চিঠি দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। মৃত্যুদ-ের রায়ের পর আইন উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, ‘শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত দেওয়ার জন্য ভারতের কাছে আবারও চিঠি দেওয়া হবে। ভারত যদি এই গণহত্যাকারীদের আশ্রয় দেওয়া অব্যাহত রাখে, তাহলে ভারতকে বুঝতে হবে এটা বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে একটা শত্রুতা এবং নিন্দনীয় আচরণ।’

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনও বলেছেন, ‘শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বিষয়ে বিচারের রায় হয়েছে, শাস্তি হয়েছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের প্রত্যর্পণ চুক্তি আছে। কাজেই তার আওতায় আমরা তাদের ফেরত চাইব।’

প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী, বাধ্যবাধকতা আছে কি নাÑ জানতে এমন প্রশ্নে রায়ের পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আইনি বিষয়ে আমি মন্তব্য করতে পারব না। আমি যেটা বুঝি যে, তাদের ফেরত আনতে হবে। আদালত শাস্তি দিয়েছে, সে জন্য আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতকে জানাব।’ ভারতের জবাব না পেলে করণীয় কি আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘স্পেকেলেকুশনের জবাব আমার কাছে পাবেন না।’

ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা কতখানি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি এটা নিয়ে এসেস করব না, কারণ আমি আইনের মানুষ না। বিভিন্ন আইনেই ফাঁক থাকে, সেটা কীভাবে পূরণ করতে হয় আইনজ্ঞ যারা তারাই বলতে পারবেন। কাজেই এই প্রশ্নগুলো আইন নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের করতে হবে। আমি শুধু এইটুকু বলতে পারি যে, আমরা চিঠি দেব তাদের ফেরত দেওয়ার জন্য।’

জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার দিল্লি সফরে প্রত্যর্পণ নিয়ে আলোচনা হবে কি না জানতে চাইলে মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘আমি উনার এজেন্ডায় হস্তক্ষেপ করতে চাই না। যদি প্রয়োজন মনে করা হয় তাহলে অবশ্যই উনি তুলতে পারেন। আমরা আমাদের অফিসিয়াল চ্যানেলেই যাব।’

তবে রায়ের পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রায়ের বিষয় জেনেছে ভারত। নিকট প্রতিবেশী হিসেবে ভারত বাংলাদেশের জনগণের সর্বোচ্চ স্বার্থের বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যার মধ্যে দেশটির শান্তি, গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তি এবং স্থিতিশীলতার বিষয় রয়েছে। সেদিক বিবেচনায় আমরা সব অংশীজনের সঙ্গে সর্বদা গঠনমূলকভাবে সম্পৃক্ত হব।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ২০১৩ সালে একটি দ্বিপাক্ষিক প্রত্যর্পণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল ভারত এবং বাংলাদেশ। পরে ২০১৬ সালে চুক্তি সংশোধন করা হয়; যাতে দুই দেশের মধ্যে পলাতক বন্দি ও আসামিদের বিনিময় আরও সহজ এবং দ্রুত হয়।  চুক্তি অনুযায়ী, কোনো অপরাধের জন্য কমপক্ষে এক বছরের কারাদ-যোগ্য অপরাধীকে একে-অপরের কাছে প্রত্যর্পণ করার আহ্বান জানাতে পারবে ভারত ও বাংলাদেশ। তবে অপরাধ ‘রাজনৈতিক প্রকৃতি’র হয় বা ফেয়ার ট্রায়ালের অভাব থাকে, তাহলে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা যাবে।

কোন কোন অপরাধের অভিযোগকে ‘রাজনৈতিক’ বলা যাবে না, সেই তালিকাও বেশ লম্বা। এর মধ্যে হত্যা, গুম, অনিচ্ছাকৃত হত্যা ঘটানো, বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো ও সন্ত্রাসবাদের মতো নানা অপরাধ আছে। এই বন্দি বিনিময় চুক্তির মাধ্যমেই ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসামের (উলফা) শীর্ষ নেতা অনুপ চেটিয়াসহ বেশ কয়েকজন পলাতক আসামিকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করেছে বাংলাদেশ। একইভাবে ভারতও এই চুক্তির মাধ্যমে পলাতক কয়েকজনকে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেছিল।

তবে ২০১৩ সালে স্বাক্ষরিত প্রত্যর্পণ চুক্তির অধীনে হাসিনার প্রত্যাবর্তন চাওয়ার অধিকার বাংলাদেশের থাকলেও বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তির মধ্যে থাকা বেশ কয়েকটি শর্তের জন্যই ভারত হাসিনাকে ফেরাতে বাধ্য নয় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এই প্রসঙ্গে ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক অনিন্দ্যজ্যোতি মজুমদার পশ্চিমবঙ্গের গণমাধ্যম আনন্দবাজারকে বলেন, ‘ভারত হাসিনাকে ফেরাতে বাধ্য নয়। কারণ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের প্রত্যর্পণ সংক্রান্ত চুক্তি থাকলেও সেখানে এমন কিছু শর্ত রয়েছে, যার জন্য নয়াদিল্লি সেটি মানতে বাধ্য নয়।’