নদীতে খাঁচায় মাছ চাষে দিন বদলের গল্প বুনছেন উপকূলের প্রান্তিক মৎস্য চাষিরা। এখন তারা খাঁচায় মাছ চাষ করে ভাগ্য ফিরিয়েছেন। সুস্বাদু মাছের উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিক সচ্ছলতা এসেছে উপকূল জুড়ে।
এতে বদলে যাচ্ছে উপকূলের অর্থনীতির চিত্র। লাভজনক হওয়ায় ক্রমেই বাড়ছে খাঁচায় মাছ চাষের পরিসর। ভোলার অভ্যন্তরে ছোট বড় প্রচুর নদী-নালা, খাল ও মুক্ত জলাশয়
থাকায় মাছ চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাষবাস ও ব্যবসা-বাণিজ্যে লোকসানে সংসার চালানোই দায় ছিল বেশিরভাগ মৎস্য চাষির। এখন কম পুঁজিতে বেশি লাভজনক হওয়ায় ভাসমান এ পদ্ধতিতে মাছ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন ভোলার মৎস্যজীবীরা।
তাই স্থানীয় মাছ চাষিদের কাছে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে নদী ও খালে খাঁচায় মাছ চাষ পদ্ধতি। এতে করে উপকূলীয় জেলায় বেকারত্ব দূরীকরণের পাশাপাশি দিন দিন মৎস্য উৎপাদনও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, ভোলা সদর উপজেলার চর সেমাইয়া, শান্তিরহাট, ভেলুমিয়া ও ভেদুরিয়া এলাকার নদী ও খালের মুক্ত জলাশয়ে প্রায় শতাধিক মৎস্যজীবী খাঁচায় মাছ চাষ করছেন। এ পদ্ধতিতে মাছ চাষ করতে জিআই পাইপ, ড্রাম, নেট দিয়ে তৈরি করেন খাঁচা।
আর প্রতিটি খাঁচা তৈরিতে খরচ হয় প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। একটি খাঁচায় সর্বোচ্চ ১ হাজারের মত মাছ চাষ করা যায়। এতে প্রয়োজন হয় না নিজের পুকুর কিংবা জলাশয়। পুঁজিও লাগে কম।
মাছ চাষি সোহাগ বলেন, প্রতি খাঁচায় ৩০০ গ্রাম ওজনের ৫০০ পিস করে মাছ ছেড়েছিলাম। দুই মাসে ওজন হয়েছে ৯০০ গ্রাম বা এক কেজি করে। প্রথমে ৪০টি খাঁচা দিয়ে শুরু করছি। এখন আরও ২০টি বানাচ্ছি। এভাবে নদীতে মাছ চাষে খরচ কম, অথচ মাছ দ্রুত বাড়ে। তাই লাভও বেশি।’
উদ্যোক্তারা জানান, প্রবাহমান নদীতে মাছ দ্রুত বড় হয়। প্রাকৃতিক পরিবেশে রোগ বালাইয়ের ঝামেলা কম, স্বাদেও সুস্বাদু। বাজারের ব্যাপক চাহিদায় লাভবান হওয়া যায় সহজেই।
কথা হয় প্রধান উদ্যোক্তা মো. আনোয়ারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘শুরুর দিকে ভাবতে পারিনি এত দ্রুত এ ধরনের সফলতা পাব। ক্রমেই আমরা এ পদ্ধতিতে মাছ চাষের পরিসর বাড়াচ্ছি। এটি কিন্তু পুকুরে চাষ করা মাছের মতো নয়। বলা যায়, প্রাকৃতিক ভাবেই মাছ বেড়ে উঠছে। এজন্য এই মাছের কালার ভালো হয়, বৃদ্ধিও পায় বেশি। সবমিলিয়ে অন্যান্য মাছের তুলনায় আমাদের মাছের স্বাদও অনেক বেশি। ফলে চাহিদাও আছে অনেক।’
ভেদুরিয়া গ্রামের পঙ্গাসিয়া নদীতে স্থাপিত ১০০টি খাঁচার প্রতিটি থেকে বছরে ৬০০ কেজি করে মোট ছয় মেট্রিক টন মনোসেক্স তেলাপিয়া উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা উদ্যোক্তাদের। যার বাজারমূল্য প্রায় ৮ লাখ টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ পদ্ধতিতে মাছ চাষের পরিসর বাড়াতে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
তারা জানান, স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গ্রামীণ জন উন্নয়ন সংস্থা(জিজেইউএস) অর্থায়ন ও পল্লি কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন(পিকেএসএফ)’র সহযোগিতায় খাঁচায় মাছ চাষ পদ্ধতি স্থানীয় মৎস্যজীবীদের কাছে পরিচিতি পায়।
এই সংস্থা বিনামূল্যে খাঁচা, জিআই পাইপ, ড্রাম, গেরাপি দড়ি, ফ্লাটবার, জালসহ প্রশিক্ষণ এবং প্রাথমিক পর্যায়ে মাছের পোনা দিয়ে মাছ চাষিদের সহযোগিতা করে। পরে এটি সবার কাছে পরিচিতি পেলে স্থানীয় মাছ চাষিরা নিজস্ব উদ্যোগে খাঁচায় মাছ চাষ শুরু করেন।
এ বিষয়ে গ্রামীণ জন উন্নয়ন সংস্থা(জিজেইউএস) টেকনিক্যাল অফিসার(ফিসারিজ) আরিফজ্জামান বলেন, ‘এ পদ্ধতিতে মাছ চাষে শুধু চাষির ভাগ্য পরিবর্তন হচ্ছে তা নয়; আমরা যদি সরকারি ও বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগে এ মাছ চাষের পরিসর বাড়াতে পারি, তাহলে নদীর যথাযথ ব্যবহারটা নিশ্চিত হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।’
তিনি বলেন, ‘খাঁচায় মাছ চাষের ফলে প্রাকৃতিক মাছ যেগুলো নদীতে রয়েছে, সেগুলোর আশ্রয়স্থল গড়ে উঠছে। অর্থাৎ এই খাঁচার নিচে ও আশপাশে নদীর মাছগুলো অবস্থান করে। কারণ, এখানে প্রচুর খাবার থাকে। ফলে এ মাছগুলোর বৃদ্ধির হার বাড়ছে এবং এখানেই প্রজননও ঘটাচ্ছে। সবকিছু বিবেচনায় খাঁচায় মাছ চাষের গুরুত্ব অনেক।’
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, উপকূলীয় নদী ও মোহনায় এই পদ্ধতিতে মাছ চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। জেলার ৭ উপজেলায় খাঁচায় মাছ চাষের সাথে কমপক্ষে সহস্রাাধিক শ্রমজীবী মানুষ জড়িত। পাশাপাশি নদীতে নির্বিঘ্নে খাঁচা তৈরি করে তা স্থাপন করে খুব সহজেই মাছ চাষ করা যায়।
যে কারণে জায়গার জন্য আলাদা কোনো টাকা খরচ করতে হয়না। পুকুরের চেয়ে নদীতে মাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায়। আবার প্রবহমান পানিতে প্রজনন ও বৃদ্ধির কারণে মাছের স্বাদও বেশি হয়। বাজারেও এ মাছের চাহিদা বেশি হওয়ায় দাম বেশি পাওয়া যায়।
প্রান্তিক মাছ চাষিরা মনে করেন, সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ পদ্ধতিতে মাছ চাষে আগ্রহী হবে ভোলার বেকার যুবকেরা। এতে একদিকে যেমন জেলার বেকারত্ব দূর হবে। অন্যদিকে, তেমনি মাছের উৎপাদনও বাড়বে।
ভোলা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব বলেন, ‘এই পদ্ধতিতে মাছ চাষে রোগ বালাইয়ের ঝুঁকি কম। প্রাকৃতিক দুর্যোগেও কম ক্ষতি হয় এবং মাছ একে অপরকে খেয়ে ফেলার আশঙ্কাও থাকে না।’
তিনি বলেন, ‘সরকার এ পদ্ধতিতে মাছ চাষে উদ্বুদ্ধ করতে প্রান্তিক মৎস্য চাষিদের নিয়মিত সহযোগিতার কথা চিন্তা করছে।’

-20250618232412.webp)




-20250618214413.webp)
-20250618211522.webp)

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন