বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা দপ্তরের সহকারী পরিচালক সেলিনা বেগম আবারও বিতর্কের কেন্দ্রে এসেছেন। তার বিরুদ্ধে একাধিক বিয়ে, সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন, ব্ল্যাকমেইল ও শারীরিক নির্যাতনের পুরোনো অভিযোগগুলো নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে দেখা যায় তিনি তার স্বামী লালমনিরহাট জেলা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল কর্মকর্তা হাসানুর রশীদকে অফিসকক্ষে শারীরিকভাবে নির্যাতন করছেন। এ ঘটনায় স্বামী হাসানুর রশীদ সম্প্রতি লালমনিরহাট সদর থানায় তার সাবেক স্ত্রীর বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন।
অভিযোগ সূত্র ও হাসানুর রশীদের দেওয়া বক্তব্য থেকে জানা গেছে, বরিশালে কর্মরত থাকাকালীন অফিসার্স ক্লাবে ব্যাডমিন্টন খেলতে গিয়ে সেলিনার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। প্রথমে সেখানে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাইলে সেলিনা আত্মহত্যার হুমকি দেন এবং পরে দাবি করেন তার গর্ভে সন্তান রয়েছে। এভাবে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়ে অবশেষে তিনি ২০২৫ সালের ১ মার্চ বিয়ে করতে বাধ্য হন। কিন্তু বিয়ের পর শুরু হয় আরেক দফা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।

হাসানুর জানান, তাকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়, তার উপর আর্থিক খরচ চাপিয়ে দেওয়া হয় এবং প্রতিনিয়ত কার সঙ্গে কোথায় কথা বলছেন তা জানাতে বাধ্য করা হতো। গত ১৯ জুন নিজ বাসায় ও গত ৩ জুলাই লালমনিরহাট অফিসকক্ষে প্রকাশ্য স্ত্রী কতৃক মারধরের শিকার হন তিনি। অবশেষে গত ৩১ জুলাই তাদের ডিভোর্স হয়।
পরে গত ১ আগস্ট তার বাসায় গিয়ে আবারো তার উপর হামলা চালানো হয়। পরে তার আত্মচিৎকার শুনে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করেন। এরপরে গত বুধবার (৬ আগস্ট) তিনি লালমনিরহাট সদর থানায় তার সাবেক স্ত্রীর বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। পরে থানা পুলিশ সেই অভিযোগটি এজহার হিসেবে গ্রহণ করেন।
শুধু তাই নয়, সেলিনার বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক অভিযোগ। তার এক সহকর্মীর সাথে কথা হলে তিনি জানান, ঢাকা মেডিকেল কলেজে পরিচয়ের পর তাকে জোরপূর্বক সম্পর্কে জড়িয়ে ভিডিও ধারণ ও ব্ল্যাকমেইলের শিকার হতে হয়েছে। প্রায় ১০ মাস ধরে নিয়মিত অর্থ সহায়তাও দিতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।
আরেক সহকর্মী বলেন, সেলিনার সাথে তার পূর্ব পরিচিত ছিল। পরে ওই সম্পর্কটি বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু বিয়ের পর সেলিনার বেপরোয়া চালচলন ও আচরণ সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়া সেই দাম্পত্য জীবন স্থায়ী হয়নি। পরে তাদের ডিভোর্স হয়। এরপর সেলিনার করা মামলায় দীর্ঘ আইনি লড়াই করতে হয়েছে তাকে।
এদিকে এক পুলিশ কর্মকর্তা অভিযোগ করে বলেন, এক অফিসার্স ক্লাবে ব্যাডমিন্টন খেলার সময় সেলিনার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। প্রথমে নিজেকে বিবাহিত পরিচয় দিয়ে স্বামী হিসেবে জাহাঙ্গীর আলম সম্রাটের নাম উল্লেখ করতেন সেলিনা। ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেন এবং এক পর্যায়ে পাশাপাশি বসে কিছু ছবি তোলেন।
ওই কর্মকর্তা আরও জানিয়েছেন, হঠাৎ একদিন সেলিনা তাকে জানালেন, স্বামী তাকে ডিভোর্স দিয়েছে এবং কারণ হিসেবে তাদের একসঙ্গে তোলা ছবিই দেখান। পরে সেই ছবিগুলো তাকে দেখিয়ে হুমকি দেন যে- স্ত্রী, আত্মীয়স্বজন এবং উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে পাঠাবেন। এতে সম্মানহানি ও চাকরিজীবন বিপন্ন হওয়ার ভয়ে তিনি মানসিক চাপে পড়েন।
‘আমি বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাই। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে স্থান পরিবর্তন করতে হয়। পরে মামলা দিয়ে আমাকে হয়রানি শুরু করে। তাঁর ফাঁদ থেকে মুক্ত হতে গিয়ে আমাকে দীর্ঘ আইনি লড়াই চালাতে হচ্ছে। তিনি বলেন, আমি একা নই, অনেকেই সেলিনার কাছে একইভাবে প্রতারিত হয়েছে’, বলেন তিনি।
জানা গেছে, এরআগেও সেলিনা বেগমের বিরুদ্ধে নানা বিতর্ক রয়েছে। ২০১৬ সালের ৩ মার্চ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে জোরপূর্বক হয়রানির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। পরে তিনি একটি মুচলেকায় স্বীকার করেন যে, রাতে তিনি ওই শিক্ষার্থীকে মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছেন। সেখানে তিনি অনুতপ্ত বলে উল্লেখ করেন এবং ভবিষ্যতে আর কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে প্রবেশ করবেন না বলে প্রতিশ্রুতি দেন। তবে সেই ঘটনার পরও তার আচরণের পরিবর্তন আসেনি ।
সেলিনা বেগমের বাড়ি পটুয়াখালীর সুবিদখালীর পূর্ব সুবিদখালী গ্রামে। স্থানীয়ভাবে তিনি ‘ময়না’ নামে পরিচিত। এলাকাবাসীর দাবি, তার প্রভাবশালী চলাফেরার কারণে প্রকাশ্যে কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পায় না। আগের সরকারের সময় তিনি একাধিক উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা ও শাসক দলের নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এ ব্যাপারে সেলিনা বেগমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি প্রথমে ফোন রিসিভ করলেও সাংবাদিক পরিচয় শোনার পর কল কেটে দেন। পরবর্তীতে তার হোয়াটসঅ্যাপ ও মুঠোফোনে বার্তা পাঠিয়ে যোগাযোগ করা হলেও কোনো উত্তর মেলেনি।
এ বিষয়ে লালমনিরহাট সদর থানার ওসি নুরনবী বলেন, ‘লালমনিরহাট জেলা কালচার কর্মকর্তার দায়ের করা অভিযোগটি মামলা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে এবং তদন্ত চলছে।’
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন