রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে লাখো ভক্তের পদচারণায় শুরু হয়েছে ঠাকুর নরোত্তম দাসের তিরোভাব তিথি মহোৎসব। উৎসবের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে মোতায়েন করা হয়েছে প্রায় ৫০০ পুলিশ সদস্য। বৈষ্ণব ধর্মাচারে বিশ্বাসী দেশি-বিদেশি সন্ন্যাসী ও ভক্তদের অংশগ্রহণে খেতুরীধাম মুখর হয়ে ওঠে অষ্টপ্রহর কীর্তন, প্রসাদ বিতরণ ও নানা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে।
গত শুক্রবার উপজেলার প্রেমতলীর খেতুরীধামে মহোৎসবটি শুরু হয়। ভক্তদের গঙ্গাস্নান ও দীর্ঘ প্রার্থনার মধ্য দিয়ে আজ (১২ অক্টোবর) এই অনুষ্ঠান শেষ হবে।
সরে জমিনে দেখা গেছে, উৎসবকে কেন্দ্র করে খেতুরীধামে বসেছে ঐতিহ্যবাহী খেতুরীর মেলা। ধর্মীয় উপকরণ ছাড়াও সেখানে পাওয়া যাচ্ছে বাহারি খাদ্যসামগ্রী, পোশাক, ব্যবহার্য ও গৃহস্থালি দ্রব্য, কারু-চারু ও কামার-কুমারের তৈরি বিভিন্ন পণ্য। যদিও এ মেলা মূলত বৈষ্ণব সন্ন্যাসীদের মিলনমেলা, তবুও অহিংসা ও মানবপ্রেমে বিশ্বাসী অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরাও সমানভাবে অংশ নিচ্ছেন।
খেতুরীধাম ট্রাস্টি বোর্ডের সম্পাদক শ্যামাপদ সান্যাল বলেন, ‘শত শত বছর ধরে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পাশাপাশি মুসলিমসহ অন্যান্য ধর্মের মানুষও এখানে আসেন। এবারও ট্রাস্টি বোর্ডের ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনের সহযোগিতায় সুষ্ঠুভাবে তিরোভাব মহোৎসব সম্পন্ন হবে বলে আশা করছি।’
গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘ঐতিহ্যবাহী এই উৎসবটি যেন যথাযথ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে, সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়—সেজন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া জেলা প্রশাসন ও জেলা পুলিশেরও দিকনির্দেশনা ও সহযোগিতা রয়েছে।”
এদিকে, গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় ঐতিহ্যবাহী খেতুরীর মেলা পরিদর্শন করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) শরিফ উদ্দিন। এসময় তিনি আয়োজকদের সাথে মতবিনিময় করেন। পরে মেলায় আগত ভক্তদেরও খোঁজখবর নেন তিনি।
গত শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া এই শতবর্ষের ঐতিহ্যমণ্ডিত তিরোভাব তিথি মহোৎসবকে ঘিরে খেতুরীধাম এখন ভক্তদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।
অহিংসা ও মানবপ্রেমের মহান সাধক ঠাকুর নরোত্তম দাস ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার প্রেমতলী পদ্মাতীরের গোপালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে খেতুরীধামেই পরলোকগমন করেন। তার পিতা ছিলেন জমিদার কৃষ্ণনন্দ দাস মজুমদার। ধনী পরিবারের একমাত্র সন্তান হয়েও নরোত্তম দাস ছোটবেলা থেকেই ছিলেন ধর্মপরায়ণ ও সংসারবিমুখ। সমাজে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা ও মানবসেবার মাধ্যমে তিনি সনাতন বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারে অসামান্য ভূমিকা রাখেন।
জীবদ্দশায় তিনি নিজ গ্রাম গোপালপুরের পাশে খেতুরীতে একটি আশ্রম নির্মাণ করে সন্ন্যাসজীবনে প্রবেশ করেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজে তার প্রভাব ছিল গভীর ও স্থায়ী। বৈষ্ণব সমাজে তিনি ‘পদাবলি কীর্তন’ বা ‘লীলা রসকীর্তন’-এর প্রবর্তক হিসেবে খ্যাত। বাংলা সংগীত ও সাহিত্য ইতিহাসে তার রচিত পদাবলি কীর্তন চার শতাব্দী ধরে জনপ্রিয় এবং মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন