বরিশাল বিভাগে ডেঙ্গু কেড়ে নিল চারটি সম্ভাবনাময় তরুণ-তরুণীর প্রাণ। তাদের সবারই ছিল স্বপ্ন, ছিল সংগ্রাম। প্রত্যেকেই ৮-১০ দিন জ্বরে ভুগেছেন। চিকিৎসকরা টাইফয়েড রোগের চিকিৎসা দেন। জ্বর না গেলে পরীক্ষায় যতক্ষণে ডেঙ্গু ধরা পড়ে, ততক্ষণে সব শেষ!
মৃত অন্যরা হলেন– নার্সিং শিক্ষার্থী ইসরাত জাহান (১৯), নবম শ্রেণির ছাত্রী উপমা (১৫), নারী উদ্যোক্তা আজমেরী মোনালিসা জেরিন (৩০) ও সদ্য স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা নাইমুল ইসলাম প্রিন্স (২৪)।
এদিকে, মেধাবী ছাত্রী ইসরাত জাহান পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির সুটিয়াকাঠি গ্রামের মো. ইদ্রিসের মেয়ে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে কৃতিত্বপূর্ণ ফলের পর ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা মা ও শিশু হাসপাতালের অধীন নার্সিং ইনস্টিটিউটে। বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল ইসরাত ঘিরে। কিন্তু ১১ জুন বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (শেবাচিম) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
খালাতো ভাই সাব্বির হোসেন বলেন, ‘প্রথমে টাইফয়েড ভেবে স্থানীয় চিকিৎসকরা ওষুধ দেন। পরে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে আবার হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশালে নেওয়া হলেও সন্ধ্যায় মারা যায় ইসরাত।’
বরগুনার সাবেক সংসদ সদস্য জাফরুল হাসান ফরহাদের মেয়ে আজমেরী মোনালিসা জেরিন ছিলেন বরগুনার পরিচিত নারী উদ্যোক্তা। কেক ও বেকারিপণ্যের ব্যবসার মাধ্যমে তিনি উদ্যোক্তা মহলে আলাদা জায়গা করে নিয়েছিলেন। গত ৬ জুন নিজের জন্মদিনেই ডেঙ্গুতে মারা যান তিনি। একইসঙ্গে পরিবারের অন্য সদস্যরাও আক্রান্ত হয়েছিলেন।
স্বামী রাকিবুল ইসলাম রাজন বলেন, ‘জেরিন তিন দিন হাসপাতালে থাকলেও একদিন শুধু এক জুনিয়র চিকিৎসক তাকে দেখতে আসেন। পরে বাইরে পরীক্ষা করে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন ছোট মেয়েটা মাকে খুঁজে ফিরছে, তাকে কী বলব বুঝতে পারি না।’
বরগুনা জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম মোল্লার মেয়ে উপমা ছিলেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। স্থানীয় চিকিৎসার ওপর ভরসা না রেখে দ্রুত ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। দুই সপ্তাহ ভেন্টিলেশনে থাকার পরও বাঁচানো যায়নি উপমাকে। মারা যান গত ২৯ এপ্রিল।
নজরুল বলেন, ‘মেয়েকে হারানোর যন্ত্রণা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। জানাজায় দাঁড়িয়ে পৌর কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলেছি। এখন রাজনীতিতে সময় দিচ্ছি, যাতে শোক ভুলে থাকতে পারি।’
বরগুনা সদরের দক্ষিণ ইটবুনিয়া গ্রামের আবুল কালামের ছেলে নাইমুল ইসলাম প্রিন্স সদ্য স্নাতকোত্তর শেষ করেছিলেন। দুই ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন বড়। পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করে সংসারের হাল ধরেছিলেন। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে তাকে ঢাকা নেওয়া হয়, কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। মারা যান গত শুক্রবার।
ডেঙ্গুতে তরুণরা কেন দ্রুত কাবু হচ্ছেন– প্রশ্নে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় পরিচালক ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এটি অনেকটা প্রকৃতির নিয়মে ঘটছে। করোনার সময়ও এমন দেখা গেছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার আগে অন্য রোগ ছিল কি না, তা বিবেচনায় নিতে হয়। বিষয়টি যাচাইয়ে চিকিৎসকদের নির্দেশনা দেওয়া হবে।’
গতকাল শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ১৬৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন একজন, যিনি চট্টগ্রাম বিভাগের বাসিন্দা। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ২৯ জন, আক্রান্ত হয়েছেন ৫ হাজার ৭৩৯ জন। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগেই ২ হাজার ৫৮৯ জন। শুধু গত ১৪ দিনেই বরিশালে আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৩৯৪ জন, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৬৬ জন।