ঢাকা শুক্রবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ইতালি যাত্রায় লিবিয়ায় আটক বাংলাদেশি ৩৮ যুবক

আগৈলঝাড়া (বরিশাল) প্রতিনিধি
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৫, ০১:১২ পিএম
লিবিয়ার জেলে বন্দি ৩৮ যুবক। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

দক্ষিণ এশিয়া এবং দরিদ্র দেশগুলোর মানুষের কাছে ইউরোপ একটি স্বপ্নের নাম। এই স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে বহু মানুষকে পাড়ি দিতে হয় বিপজ্জনক ভূমধ্যসাগর। তারপরও থেমে নেই ইউরোপ যাত্রা।

ইউরোপের দেশ ইতালিতে উন্নত জীবনের খোঁজে লিবিয়ার উপকূল বেনগাজী থেকে সাগরপথে ঝুঁকিপূর্ণভাবে যাত্রা করে নিখোঁজ হয়েছিলেন বরিশালের ৩৮ জন যুবক। গত এগারো দিন ধরে তাদের কোনো সন্ধান না পাওয়ায় চরম হতাশা ও কান্নায় ভেঙে পড়েন নিখোঁজদের পরিবারের সদস্যরা। অবশেষে তাদের সন্ধান মিলেছে লিবিয়ার একটি জেলখানায়।

নিখোঁজ হওয়ার পর দালালচক্রের বিভিন্ন এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) রাতে এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন ইতালি প্রবাসী, গৌরনদী উপজেলার খাঞ্জাপুর ইউনিয়নের ডুমুরিয়া গ্রামের জামাল মোল্লার ছেলে জাকির হোসেন মোল্লা।

জাকির জানান, এজেন্টরা তাকে জানায়, লিবিয়ার উপকূল বেনগাজী থেকে ওই ৩৮ জনকে আটক করেছে দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের সঙ্গে আরও একটি নৌকার ৩২ জনকেও আটক করা হয়েছে। মোট ৭০ জন বাংলাদেশি আটক রয়েছেন। এদের মধ্যে ওই ৩৮ জন ছাড়াও আরও ১১ জন গৌরনদীর বাসিন্দা রয়েছেন। আটককৃতদের অধিকাংশই গৌরনদীর বার্থী ও খাঞ্জাপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা। এর মধ্যে তার (জাকির) স্বজনরাও রয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে লিবিয়ার কারাগারে আটক যুবকদের স্বজনরা জানান, বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বার্থী ও খাঞ্জাপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের ৩৮ জন যুবক চলতি বছরের ২৩ আগস্ট বাংলাদেশ থেকে ওমরাহ হজের ভিসায় প্রথমে সৌদি আরব যান। সেখান থেকে দালাল সিন্ডিকেটের এজেন্টদের মাধ্যমে চোরাইপথে লিবিয়ায় প্রবেশ করেন। পরবর্তীতে ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তারা পরিবারের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করেন। এরপর থেকে তারা নিখোঁজ ছিলেন।

সূত্র মতে, প্রত্যেক যুবক তাদের সহায়-সম্পদ বিক্রি করে বা ধারদেনা করে ১৫ লাখ টাকা করে তুলে দিয়েছেন দালাল চক্রের হাতে। তারা সবাই অবৈধভাবে ও ঝুঁকিপূর্ণভাবে সমুদ্রপথে ইতালি যাওয়ার জন্য এই টাকা পরিশোধ করেছেন।

পরবর্তীতে দালাল সিন্ডিকেটের এজেন্টদের নির্দেশে চলতি মাসের ৯ সেপ্টেম্বর লিবিয়ার সময় রাত ১টার দিকে বেনগাজীর উপকূলের ‘গেম ঘর’ নামক এলাকা থেকে ঝুঁকিপূর্ণ নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন তারা। পথিমধ্যে লিবিয়ার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে আটক হন। ফলে উন্নত জীবনের খোঁজে যাত্রা করা এসব যুবকের স্বপ্ন রূপ নেয় দুঃস্বপ্নে।

অন্যদিকে, গত এগারো দিন ধরে পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না থাকায় নিখোঁজ যুবকদের পরিবারে নেমে আসে গভীর বিষাদের ছায়া। অবশেষে ইতালি প্রবাসী দালালচক্রের সদস্য গৌরনদীর খাঞ্জাপুর গ্রামের জাকির হোসেন মোল্লার ফোনের মাধ্যমে জানা যায়, ওই যুবকরা লিবিয়ার একটি কারাগারে বন্দি আছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লিবিয়ার কারাগারে আটক ৩৮ জন যুবকের মধ্যে যাদের পরিচয় পাওয়া গেছে তারা হলেন: বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বার্থী গ্রামের মো. আমিনুল ইসলাম, রহিম হাওলাদার, মো. অহিদুল হাওলাদার, সুজন খান, সবুজ মোল্লা; বড় দুলালী গ্রামের রাহুল সরদার, শাহ আলী বয়াতী, বাবুল বেপারী, তানভির হোসেন হৃদয়, মাসুদ তালুকদার, রাব্বী সরদার, রিয়াজুল বেপারী, বিপুল সরকার, শাহাদাত সিকদার, মো. রিমন মীর, তৌহিদ হাসান হৃদয়; উত্তর বাউরগাতী গ্রামের ফাহিম প্যাদা, ইব্রাহিম প্যাদা, শামিম সরদার; তারাকুপি গ্রামের মুন্না বয়াতী; উত্তর মাদ্রা গ্রামের শান্ত দত্ত; বাঙ্গিলা গ্রামের সুমন কাজী; খাঞ্জাপুর ইউনিয়নের পূর্ব ডুমুরিয়া গ্রামের কামরুল বেপারী; ছোট ডুমুরিয়ার মেহেদী হোসেন খান; পশ্চিম ডুমুরিয়ার বাবুল মোল্লা; পূর্ব সমরসিংহ গ্রামের আবুবক্কর মোল্লা; উত্তর মাগুরার সাদ্দাম বেপারী; আগৈলঝাড়ার আলী হোসেন বেপারী; মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার সজিব বেপারী; কালকিনির ফারহান হোসেন জয়।

আটক এক যুবকের বিধবা মা নাজমা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “আমার ছেলে বলেছিল, ‘মা, তুমি অনেক কষ্ট করেছ, আর কষ্ট করতে হবে না। এখন আমার বুকের মানিক কোথায় আছে, কেমন আছে জানি না। অনেক কষ্ট করে সহায়-সম্পদ বিক্রি করে ও ধারদেনা করে ছেলে তার স্বপ্ন পূরণ করতে চেয়েছিল।”

একজন আটক যুবকের পিতা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, ‘জাকির মোল্লার মাধ্যমে আমার ছেলেকে ইতালি পাঠানো হয়েছে। এ জন্য জাকিরকে ১৫ লাখ টাকা দিতে হয়েছে, যা ব্যাংক হিসাব ও বিকাশের মাধ্যমে পরিশোধ করেছি। এভাবে ঝুঁকি নিয়ে যেতে হবে এই তথ্য আমাদের জানানো হয়নি।’

জাকির হোসেনের বোন তানিয়া আক্তার জানান, ‘আমার ভাই কাউকে জোর করে নিয়ে যায়নি। ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও সবাই স্বেচ্ছায় গিয়েছেন। এখন যেকোনো উপায়ে তাদের জেল থেকে মুক্ত করার জন্য দালাল সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে আমার ভাই। বন্দিদের মধ্যে আমাদের আত্মীয়রাও রয়েছেন।’

গৌরনদী থানার ওসি তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘ফেসবুকে বিষয়টি দেখেছি। এ বিষয়ে খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে। কেউ যদি থানায় লিখিত অভিযোগ দেয়, তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’