ঢাকা শনিবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৫

তিস্তার বন্যায় কৃষকের স্বপ্নভঙ্গ

কালীগঞ্জ (লালমনিরহাট) প্রতিনিধি
প্রকাশিত: আগস্ট ১৬, ২০২৫, ০৫:৩৪ পিএম
বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও দুর্ভোগ বেড়েছে লালমনিরহাটের তিস্তাপাড়ে। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

টানা তিন দিন পরে বন্যার পানি নেমে গেলে ভেসে উঠে ক্ষত। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও দুর্ভোগ বেড়েছে লালমনিরহাটের তিস্তাপাড়ে। রোপা আমন খেত পঁচে গলে নষ্ট হওয়ায় দুঃচিন্তার ভাঁজ পড়েছে কৃষকদের কপালে।

জানা গেছে, উজানের ঢল ও টানা ভারি বৃষ্টিতে হু হু করে বেড়েছে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ। গত সোমবার (১১ আগস্ট) রাতে ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে। মঙ্গলবার সকাল থেকে বন্যায় প্লাবিত হয় লালমনিরহাটের ৫টি উপজেলার অধিকাংশ এলাকা। টানা তিন দিনের বন্যায় ডুবে যায় নদী তীরবর্তী অঞ্চলের ফসলি খেত। পানিবন্দি হয়ে পড়ে জেলার প্রায় ২৫ হাজার পরিবার। পানি তোরে ভেসে গেছে মৎস্যচাষিদের পুকুরের মাছ। বিশেষ করে আমন খেত ও বীজতলা ডুবে যাওয়ায় কৃষিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

শুক্রবার (১৫ আগস্ট) পানি কমে গেলে জেগে উঠে বন্যার ক্ষত। আমনের লাগানো চারা বন্যার পানিতে পঁচে গলে নষ্ট হয়েছে। অধিকাংশ খেতে শুধু মাটি ও বালু পড়ে আছে, নেই কোন আমনের চারা। কিছু খেতে চারা দেখা গেলেও শুক্রবারের প্রচণ্ড রোদে তা গলে পঁচে যাচ্ছে। মাত্র এক সপ্তাহ আগে দ্বিতীয় দফার বন্যায় নষ্ট হওয়া আমন খেতে নতুন করে চারা লাগিয়েছিলেন নদীপাড়ের কৃষকরা। সেটাও তৃতীয় দফার বন্যায় ৩-৪ দিন ডুবে নষ্ট হয়েছে। নতুন করে লাগানোর মতো চারা নেই অধিকাংশ চাষির। ফলে আমন নিয়ে দুঃচিন্তার ভাঁজ পড়েছে তিস্তাপাড়ের কৃষকদের কপালে।

টানা ৩-৪ দিন পর বাড়ি ও ঘর থেকে বন্যার পানি নেমে গেলেও দুর্ভোগ কমেনি নদীপাড়ে। পানির তোড়ে নষ্ট হওয়া ঘরবাড়ি ও বেড়া মেরামত করতে ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। বন্যার পানির সঙ্গে ভেসে আসা ময়লা-আবর্জনা প্রতিটি বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। ঝোপঝাড়ে আশ্রয় নিয়েছে সাপ-পোকামাকড়। অনেকের গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র ভিজে নষ্ট হয়েছে। নদীপাড়ের কিছু বিদ্যালয়ের আসবাবপত্রও বন্যার পানিতে নষ্ট হয়েছে।

লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, তৃতীয় দফার বন্যায় জেলার ৯১৫ হেক্টর জমির আমন ধান এবং ৬৩ হেক্টর জমির অন্যান্য ফসল নিমজ্জিত হয়েছে। যদিও সামান্য কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হলেও নতুন করে রোপণ করার সময় রয়েছে।

হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী ইউনিয়নের কৃষক আব্দুর রহমান বলেন, ‘আমরা অনেক কষ্ট করে চাষাবাদ করি। কিছুদিন আগে একবার বন্যায় ডুবে গিয়ে আমার ৩ বিঘা জমির আমন ধান নষ্ট হয়েছিল। চারা ক্রয় করে দ্বিতীয় দফায় রোপন করেছিলাম। সেটাও এক সপ্তাহের ব্যবধানের বন্যায় ডুবে নষ্ট হয়ে গেছে। এখন চারা কেনার টাকা নেই। চারা রোপন না করলে পরিবার কী খাবে? আমরা কিভাবে বাঁচবো, জানি না।’

তিস্তা পাড়ের বাসিন্দা মর্জিনা বেগম বলেন, ‘তিস্তা আমাদের সর্বনাশ করে দিয়েছে। বছরের পর বছর চাষাবাদে অনেক খরচ করেও আমরা লাভবান হতে পারি না। যা আবাদ করি, তার দামও ঠিকমতো পাই না। কিন্তু এবারের বন্যায় আমাদের সবকিছু শেষ করে দিয়েছে। সামনের দিনগুলো কেমন যাবে, আমরা কিভাবে বাঁচবো, সেটা কেউই জানে না। ত্রাণসহ স্থায়ী বাঁধ চাই।’

শুক্রবার তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে দিনভর বিপদসীমার নিচে প্রবাহিত হয়। ফলে লালমনিরহাটে বন্যা পরিস্থিতি যথেষ্ট উন্নত হয়েছে। তবে পানি কমায় নদীতে ভাঙন বেড়ে গেছে। তিস্তা নদীর বাম তীরে বেশ কয়েকটি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। কালীগঞ্জে দক্ষিণ ভোটমারী, হাতীবান্ধার সিন্দুর্না এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে সিন্দুর্না সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ অসংখ্য বসতবাড়ি, ফসলি জমি ও স্থাপনা।

সিন্দুর্না ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আরিফুর ইসলাম বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের তিস্তা চরের আমন খেতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বন্যার পানি নেমে গেলে ভাঙন বেড়ে গেছে। চর অঞ্চলের সিন্দুর্না সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নদী ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে। ভাঙন রোধে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান।’

লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. সাইখুল আরিফিন বলেন, ‘বন্যার পানিতে ডুবে আমন খেত সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে নদীপাড়ের চাষিরা বন্যা কালিন সময়ে উঁচু এলাকায় আমনের বলান করে রাখেন। পানি নেমে গেলে নষ্ট হওয়া খেতে সেই চারা রোপন করতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। আমনের চারা রোপণের এখনও সময় রয়েছে।’

পানি উন্নয়ন বোর্ড লালমনিরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী শুনীল কুমার বলেন, ‘তিস্তা নদীর পানি কমায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। পানিবন্দি পরিবারগুলো মুক্তি পেয়েছে। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে নদীতে ভাঙন দেখা দেয়। সেজন্য নদীপাড়ে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।’